খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। আওয়ামী লীগের আমলে প্রভাব খাটিয়ে বের করে নেওয়া জনতা ব্যাংকের বেশিরভাগ ঋণই এখন খেলাপিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ডিসেম্বরভিত্তিক ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ৭২ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৭ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭২ শতাংশ। তিন মাস আগে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ছিল ৯১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। ওই সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা বা ৬৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। সে হিসাবে ৩ মাসের ব্যবধানে জনতা ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা বাড়লেও খেলাপি বেড়েছে ৬ হাজার ৮০২ কোটি টাকা।
জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান জনতা ব্যাংকের সবচেয়ে বড় খেলাপি গ্রাহক। শুধু তিনিই নন, আওয়ামী লীগ আমলে প্রভাব খাটিয়ে বের করে নেওয়া চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম গ্রুপ ও অন্য কোম্পানি এননটেক্সসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণই এখন জনতা ব্যাংকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উচ্চ খেলাপি ঋণ ও জনতা ব্যাংকের তারল্য সংকট নিয়ে জানতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবুর রহমানকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি কালবেলাকে বলেন, বিগত সরকারের আমলে দেশের ব্যাংক খাতে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো, সাইফুল আলম মাসুদের এস আলম গ্রুপসহ কয়েকটি শিল্পগ্রুপ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। তারা প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন। ওইসব ঋণই এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে। এতে একদিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি বাড়ছে, অন্যদিকে আমানতকারীদের ঝুঁকিও বাড়ছে। শুধু তা-ই নয়, দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও বাংলাদেশের ইমেজ সংকট তৈরি হতে পারে। এতে বিদেশি বাণিজ্যে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের খরচ বাড়তে পারেও বলে জানান তিনি।
জানা যায়, আওয়ামী লীগের আমলে অল্প কয়েকটি গ্রুপের কাছে জনতা ব্যাংকের ঋণ পুঞ্জীভূত হয়ে পড়েছে। এসব গ্রুপের মধ্যে মাত্র ২৩টি গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় ব্যাংকটি। এই ঋণের বেশিরভাগ খেলাপিতে পরিণত হলেও এগুলো উদ্ধারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছে না ব্যাংকটি। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার না করে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকা ধার চেয়েছে জনতা ব্যাংক। কিন্তু তাদের টাকা ধার দিতে রাজি হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো টাকা দেওয়া হবে না। গ্রাহকদের দেওয়া টাকা উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ঋণের বিপরীতে যে জামানত রাখা আছে প্রয়োজনে সেগুলো বিক্রি করে টাকা আদায় করার পরামর্শ দেন তিনি। যদি ওইসব জমি বিক্রি করা না যায় তাহলে অন্য কোনো ফরমেটে টাকা উত্তোলনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন জমিতে ফ্ল্যাট করে ফ্ল্যাট বিক্রিরও পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জনতা ব্যাংকের বড় গ্রাহক যারা: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকোকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। বহুল আলোচিত বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। এই ঋণের বেশিরভাগই এখন খেলাপি। এরপর জনতা ব্যাংক থেকে দ্বিতীয় শীর্ষ ঋণ গ্রহীতা হলো চট্টগ্রামভিত্তিক আলোচিত ব্যবসায়িক গ্রুপ এস আলম। গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে জনতা ব্যাংকে ঋণ রয়েছে ৭ হাজার ৮৩২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ১ হাজার ২১৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ব্যাংক খাতের ঋণ কেলেঙ্কারির আরেক আলোচিত নাম এননটেক্স। এই প্রতিষ্ঠানটি জনতা ব্যাংক থেকে ৭ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের প্রায় শতভাগই খেলাপির খাতায় চলে গেছে। এননটেক্সে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৭০৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
এর মধ্যে এননটেক্সকে দেওয়া ঋণের টাকা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগও উঠেছে। এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে দুদকের পক্ষ থেকে রেকর্ড সংগ্রহের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি চিঠিও দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জনতা ব্যাংক থেকে রিম্যাক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের নেওয়া ১ হাজার ৭৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা ফান্ডেড ঋণের পুরোটাই খেলাপি হয়ে পড়েছে। আর ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ ২ হাজার ৮৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ঋণের মধ্যে ১ হাজার ৮০৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকাই খেলাপি। রতনপুর গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ১ হাজার ২২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যার পুরোটাই এখন খেলাপি। এ ছাড়া চৌধুরী গ্রুপকে ব্যাংকটির দেওয়া ৬৫৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকার ঋণের মধ্যে ৬২৫ কোটি ৭০ লাখ টাকাই খেলাপি হয়ে পড়েছে।
মন্তব্য করুন