অবশেষে চূড়ান্ত হয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের তারিখ। কয়েক দফা পিছিয়ে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদ ভবন সংলগ্ন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে রাজনৈতিক দলটি। এদিন প্রায় দুই লাখ মানুষের জমায়েতের পরিকল্পনা করছেন নাগরিক কমিটির নেতারা। তবে নতুন দলের নাম এবং প্রতীক এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
জাতীয় নাগরিক কমিটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, আত্মপ্রকাশের দিন ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হবে। শুরুতে আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, মুখ্য সংগঠক এবং মুখপাত্র—এ চারটিকে শীর্ষ পদ হিসেবে রেখে দল গঠনের কথা ভাবা হলেও এর সঙ্গে আরও কয়েকটি পদ যুক্ত হবে বলে জানা গেছে। আহ্বায়ক হিসেবে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের থাকা প্রায় চূড়ান্ত। আজ মঙ্গলবার বা আগামীকাল বুধবার সরকার থেকে পদত্যাগের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি। আহ্বায়ক হিসেবে আর কারও নাম এখন পর্যন্ত আলোচনায় নেই।
মূলত সদস্য সচিব পদ নিয়েই কয়েকদিন ধরে জাতীয় নাগরিক কমিটিতে আলোচনা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা গিয়েছিল। নাগরিক কমিটির একাধিক সূত্র কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে, সদস্য সচিব হিসেবে আখতার হোসেনই চূড়ান্ত হয়েছেন। আখতার বর্তমানে নাগরিক কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। আখতার ছাড়াও নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদের নাম আলোচনায় ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাগরিক কমিটির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা কালবেলাকে বলেন, সদস্য সচিব পদে কয়েকজন আলোচনায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আখতার হোসেনকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে নিজেদের মধ্যেও কয়েক দফায় আলোচনার পর আখতার হোসেন সদস্য সচিব পদে থাকার বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। এ বিষয়ে খুব বেশি বিরোধিতা কাউকে করতে দেখা যায়নি। নাহিদ-আখতারের নেতৃত্বেই হচ্ছে নতুন দল।
সূত্র আরও জানায়, মুখপাত্র এবং মুখ্য সংগঠক পদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম থাকার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া শীর্ষ পদগুলোতে নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ, মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, তাসনিম জারা ও আরিফুল ইসলাম আদীব, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ থাকবেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকবেন আরিফুল ইসলাম আদীব, আলাউদ্দীন মোহাম্মদ, মনিরা শারমীন, এস এম সাইফ মোস্তাফিজ, মোল্লা ফারুক এহসান, ডা. মাহমুদা মিতু, অনিক রায়, আকরাম হুসাইন, আলী নাছের খান, খালেদ সাইফুল্লাহ ও সালেহ উদ্দীন সিফাত।
নতুন দলের আত্মপ্রকাশকে কেন্দ্র করে গতকাল সোমবার জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা রাজধানীর বাংলামটরে রূপায়ণ টাওয়ারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সময় আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, জুলাই আন্দোলনে শহীদদের পরিবার, আহত ব্যক্তিরা, বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, প্রবাসীদের প্রতিনিধি এবং নৃগোষ্ঠীসহ ধর্ম ও রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব জাতি-গোষ্ঠীর প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন বলে জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ছাত্রদের রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ নিয়ে সারা দেশের মানুষের যে অপেক্ষা, আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি তার অবসান হচ্ছে। এদিন যে দলটির আত্মপ্রকাশ হতে যাচ্ছে, সে দলে বাংলাদেশের প্রচলিত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ এবং দলীয় স্বার্থের বাইরে একমাত্র দেশের স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। সারজিস বলেন, আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে যাচ্ছে।
সারজিস বলেন, আমরা বিশ্বাস করি হাজারো শহীদের জীবনের ওপরে লাখ লাখ ভাইবোনের রক্তের ওপর দাঁড়িয়েছে যে নতুন বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশে দীর্ঘ লড়াই করে আগামী প্রজন্মকে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ উপহার দেওয়া আমাদের কাছে একটি আমানত। আমরা আমাদের এই লড়াইটি করে যেতে চাই। সেই লড়াই সামনে রেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ঐক্যবদ্ধভাবে একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। এখানে ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ, বাংলাদেশের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, দল গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে গত এক মাসে আমরা সারা দেশে ‘আপনার চোখে নতুন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছি। এতে সব শ্রেণি-পেশার দুই লাখেরও বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন। এ মানুষেরা ক্যাম্পেইনে জানিয়েছেন, দেশ গঠন করতে হলে এমন একটা রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন, যারা দুর্নীতিমুক্ত ও পরিবারতন্ত্রের বাইরে এসে দেশ গঠনে কাজ করে যাবে। মানুষ বিশ্বাস করে তাদের এসব পরামর্শ নতুন প্রজন্ম বাস্তবায়ন করতে পারবে।
নবগঠিত দলের কাঠামো ও নেতৃত্ব সম্পর্কে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে আখতার জানান, এখন পর্যন্ত আমাদের দলের নাম চূড়ান্ত হয়নি। সারা দেশের মানুষ যেসব প্রস্তাব দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে ত্রিশটির মতো নাম আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। ২৮ তারিখে আমরা আহ্বায়ক কমিটির মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করব। সেদিনই দলের নাম, কাঠামো এবং নেতৃবৃন্দের নাম জানাতে পারব। তিনি আরও বলেন, নবগঠিত দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ ভোটের মাধ্যমে দলীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেতৃত্ব চূড়ান্ত করা হয়েছে। সামনের দিনেও সদস্যদের সরাসরি ভোটেই এ দলটির নেতা নির্বাচন করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল ও মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ।
মন্তব্য করুন