কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৪৪ এএম
আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:১১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দুর্নীতি ও লুটপাট

এস আলম-কেডিএস গ্রুপ মিলে আল আরাফাহ ব্যাংক ‘ডাকাতি’

এস আলম-কেডিএস গ্রুপ মিলে আল আরাফাহ ব্যাংক ‘ডাকাতি’

১৯৯৫ সালে সাবেক সচিব এজেডএম শামসুল আলম এবং তার কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোগীকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক পিএলসি। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের উৎপাদনমুখী করে বৃহৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা ও স্বাবলম্বী করে তোলাই ছিল ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ব্যাংকটি একরকম ডাকাতি করে দখলে নেয় এস আলম গ্রুপ ও কেডিএস গ্রুপ। ব্যাংকটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে ইচ্ছামতো দুর্নীতি ও লুটপাট চালায় এই দুই গ্রুপ। এ ছাড়া এই দুই গ্রুপ তাদের সুবিধা অনুযায়ী ব্যাংকের বিভিন্ন নিয়মকানুনকে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য কাটছাঁট করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর দেওয়া এক চিঠিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটি তাদের ব্যবসা সুষ্ঠুভাবেই পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও এস আলমের ভাই আব্দুস সালাম লাবু এবং কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান ব্যাংকটিতে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে নজিরবিহীন লুটপাট চালায়। ব্যাংকের বোর্ডে তাদের ঘনিষ্ঠজনদের নিয়োগ দিয়ে একক আধিপত্য গড়ে তোলেন। প্রথমে তারা প্রতিষ্ঠাতা এজেডএম শামসুল আলমকে ব্যাংক থেকে বের করে দিয়ে দুই গ্রপের পারস্পরিক সম্পর্কিত লোকজনকে নিয়োগ দেন। আব্দুস সালাম লাবু ব্যাংকটির ২৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ শেয়ার এবং কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে সেলিম রহমান ব্যাংকের ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ শেয়ার হাতিয়ে নেন। এরপর একই বছরের শেষের দিকে খলিলুর রহমানের ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর ভাই বদিউর রহমানকে বসানো হয় চেয়ারম্যান পদে।

এরপর থেকেই তাদের লুটপাটের আয়োজন শুরু করে। এরপর পর্যায়ক্রমে ব্যাংকটির পরিচালক পদ থেকে ৭ জনকে বের করে দেওয়া হয়।

খলিলুর যেভাবে ব্যাংকে ক্ষমতা দেখান: গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, আল আরাফাহ ব্যাংকের দুজন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন আব্দুল হাদী ও মো. এজহার মিয়া। কেডিএসের খলিলুর রহমান তাদের দুটি শেয়ার তার নিজের দখলে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। তারা রাজি না হলে আওয়ামী লীগ সরকারের উঁচু মহলের মাধ্যমে ব্যাংকের পর্ষদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এই দুই পরিচালকের স্বাক্ষর ছাড়াই টিপসই দিয়ে শেয়ার দুটি নিজের ছেলে সেলিম রহমান এবং ছোট ভাই আহমেদুল হকের নামে করে নেন।

বিনিয়োগের নামে লুটপাট: এস আলম গ্রুপ ও কেডিএস গ্রুপ বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ দেখিয়ে তা লুটপাট করে। পারস্পরিক সমঝোতায় অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের মনোনীত ব্যক্তির নামে বিনিয়োগ দিয়ে আল আরাফাহ ব্যাংক থেকে সেই বিনিয়োগের অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এর মধ্যে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ নথি, গ্রাহকের উপযুক্ততা, সহায়ক জামানতের বিষয়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করলে তা বেরিয়ে আসবে বলে গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে দাবি জানানো হয়।

১৫ বছর ধরে দুই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকের পর্ষদ: অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ব্যাংকটিতে মোট তিনজন এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের প্রত্যেকেই দুই গ্রুপের একান্ত বাধ্যগত। এ ছাড়া ২০০৯ সাল থেকে এই দুই গ্রুপের পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি, সাবসিডিয়ারি কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ সব গুরুত্বপূর্ণ পদে এস আলম ও কেডিএস গ্রুপের বাইরে কাউকে জায়গা দেওয়া হয়নি।

বর্তমান এমডি লুটপাটের দোসর: চিঠিতে বলা হয়, ব্যাংকের বর্তমান এমডি ফরমান আর চৌধুরী এস আলম এবং কেডিএস গ্রুপ মনোনীত এবং তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড ও লুটপাটের দোসর। তিনি তার নিয়োগপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যাংকসমূহে ইন্টার ব্যাংক মানি মার্কেটের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকার জোগান দিয়েছেন। শ্রেণি বিন্যাসিত বিনিয়োগে প্রকৃত পরিমাণ ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন। তিনি অনৈতিকভাবে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ পুনঃতপশিল করেছেন।

পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারিতে নাম এলেও বহাল তবিয়তে: জানা যায়, এআইবিএল ক্যাপিটাল মার্কেট সার্ভিসেস লিমিটেডের শীর্ষ কর্মকর্তা রেজাউর রহমানসহ অন্তত ১০ জন কর্মকর্তা পারস্পরিক যোগসাজশে প্রতিষ্ঠানটি বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি করেছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে তারাসহ বদিউর রহমান ও খলিলুর রহমান (কেডিএস গ্রুপের কর্ণধার) প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটে নিয়েছেন। কর্মকর্তারা বেনামে এবং কেউ কেউ নিজের স্ত্রী, বাবা, ভাই, বোন ও নিকটাত্মীয়ের নামে বিও হিসাব খুলে চেক ডিজঅনার পদ্ধতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে দুর্নীতি ও অবৈধ আয় করেছেন।

২০১০-১১ সালে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির অন্যতম নায়ক (জুয়ারি) হলেন রেজাউর রহমান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনে পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারিতে রেজাউর রহমানের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিকিউরিটজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (সিএসই) তাকে এআইবিএল ক্যাপিটাল থেকে বহিষ্কারসহ তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়। বদিউর রহমান কমিশনের ওই নির্দেশনা উপেক্ষা করে রেজাউর রহমানকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করার পরিবর্তে সুরক্ষা দেন এবং তাকে এআইবিএল ক্যাপিটাল থেকে ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি বদলি করে ডিএমডি হিসেবে ফের ব্যাংকে পদায়ন করেন। কাগজে-কলমে তাকে ব্যাংকে পদায়ন দেখানো হলেও মূলত তিনি তখনও পূর্ববর্তী পদেরই দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখানে লোক দেখানো নিম্ন পদবির একজনকে সিইও হিসেবে দেখানো হয়। রেজাউর রহমানকে ব্যাংকে পদায়নের ফলে তিনি হয়ে যান ব্যাংকের জ্যেষ্ঠতম ডিএমডি। অথচ ব্যাংকিং বিষয়ে তার খুব বেশি অভিজ্ঞতা ছিল না। অন্যদিকে, ওই সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানেও অফিশিয়ালি তার কোনো পদপদবি ছিল না। অথচ তার পেছনে ব্যাংকের মাসিক ব্যয় হয়েছে ১০ লাখ টাকার বেশি।

আব্দুস সামাদ লাবু এবং সেলিমুর রহমানের অবৈধ বিনিয়োগ বাণিজ্য: অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকের প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ লাবু এবং কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে সেলিমুর রহমান চট্টগ্রামের প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোককে নিয়োগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। লাবু ঘুষ বাণিজ্য করেছেন তার পিএস পিয়ারো এবং খুলনার দেলোয়ারসহ অসংখ্য সোর্সের মাধ্যমে। লাবুর পিএস পিয়ারোর ব্যাংক হিসাবে ১৫ কোটি টাকা উদ্ধারের মাধ্যমে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আর সেলিমুর রহমান ঘুষ বাণিজ্য করতেন তার পিএস কাজী সাহেদ জামিলের মাধ্যমে। তিনি এখনো বর্তমান চেয়ারম্যানের পিএস হিসেবে রয়েছেন।

আব্দুস সামাদ লাবুর মেয়ের জামাইকে এক্সিম ব্যাংকের ঋণ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারকে মতিঝিল শাখা থেকে ৫৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ দিয়ে খেলাপি লোনে পরিণত করা হয়। আব্দুস সামাদ লাবু এবং সেলিমুর রহমান পতিত শেখ হাসিনা সরকারকে খুশি করার জন্য ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা তুলে দিয়েছেন। ব্যাংকের সিএসআর খাতে টাকা না থাকা সত্ত্বেও কিছুদিন শেখ হাসিনার মায়ের নামে হাসপাতাল করার অজুহাতে দিয়েছেন ২০ কোটি টাকা। কম্বল বিতরণের নামেও ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

বর্তমান চেয়ারম্যান-এমডিকে শেয়ার হস্তান্তরের নামে প্রলোভন: ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান এবং দু-একজন পরিচালককে কেডিএস গ্রুপ শেয়ার দেওয়ার নামে প্রলুব্ধ করছে, যেন তারা সব সময় এখানে পরিচালক হিসেবে থাকতে পারেন। অভিযোগ রয়েছে, কেডিএস গ্রুপ বর্তমানে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের শেয়ার দেওয়ার নাম করে ফাঁদে ফেলতে চাইছেন। শেয়ার দেওয়ার মাধ্যমে চেয়ারম্যান এবং পরিচালকদের অবস্থান আরও শক্ত হয় এবং দুই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকটি থাকে। এ ছাড়া তাদের চাইলেও যেন ব্যাংক থেকে কেউ সরিয়ে দিতে না পারে। তা ছাড়া বিভিন্ন নতুন কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত এমডি ও সিনিয়র পদবিতে চাকরি দেওয়া হয়েছে, যারা এস আলম এবং কেডিএস গ্রুপের একান্ত আপনজন।

ব্যাংকের বৃহত্তর স্বার্থে যেসব উদ্যোক্তা পরিচালক ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিলেন এবং ব্যাংকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করে ব্যাংকটিকে শীর্ষস্থানে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের মধ্য থেকে পরিচালক নিযুক্ত করে নতুন বোর্ড গঠন করার জন্য চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে আল আরাফাহ ব্যাংকের এমডি ফরমান আর চৌধুরীর মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও এর জবাব দেননি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিরাজগঞ্জে ৩ মরদেহ উদ্ধার

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তানের আশা টিকিয়ে রাখবে টাইগাররা?

ছিনতাই রোধে পুলিশের ৩ বিশেষায়িত ইউনিট মাঠে নামছে : আইজিপি

আতিক-নজরুলসহ ৪ জন ফের রিমান্ডে

দেশের স্থিতিশীলতা নষ্টে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে : আইজিপি

এনসিসি ব্যাংকে নিয়োগ, নারী-পুরুষ উভয়ে আবেদন করুন

আন্তঃস্কুল বাংলা অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেল ১৪৮ জন 

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন / ট্রাম্পের ‘চাঁদাবাজির’ প্রস্তাবে কী করবে ইউক্রেন

দুই সাবেক এমপি ও তিন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধার মামলা

ইউগ্লেনা পাউডারের পুষ্টিগুণ ও ব্যবহৃত রান্নার তেলের সচেতনতা নিয়ে গোলটেবিল আলোচনা

১০

প্রধান বিচারপতির সংস্কার উদ্যোগে ইইউর সমর্থন প্রকাশ 

১১

‘কব্জিকাটা গ্রুপের’ টুন্ডা বাবু ও রিফাতসহ গ্রেপ্তার ৬

১২

পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তির বদ মতলবের কারণে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে : আসিফ নজরুল

১৩

পুলিশের হাত থেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে ছিনিয়ে নিলেন বিএনপি নেতাকর্মীরা

১৪

আলোচনা স্থগিত, পশ্চিম তীরে ট্যাংক পাঠাল ইসরায়েল

১৫

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রতিনিধি দলের ইউআইইউ পরিদর্শন

১৬

কক্সবাজার বিমানঘাঁটিতে দুর্বৃত্তদের হামলা

১৭

ঢাবির ছাত্রলীগ নেতা সুমনকে বেধড়ক পিটুনি

১৮

এইও মর্যাদা পেল ১০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

১৯

ডিজিটাল বোর্ডে ভেসে উঠল ‘হাসিনাকে আবার দেশে দেখতে চাই’

২০
X