বরাবরই রোজার মাসকে সাংগঠনিকভাবে কাজে লাগায় বিএনপি। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। এবার ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে স্বাভাবিক রাজনীতি ও ভোটের প্রচারে ব্যস্ত থাকবে দলটি। আসছে মার্চে শুরু হতে যাওয়া রমজানে কেন্দ্রীয়ভাবে কয়েকটি ইফতার মাহফিলের আয়োজন করবে বিএনপি। এরই মধ্যে চারটি ইফতার মাহফিলের সূচি চূড়ান্ত হয়েছে। পাশাপাশি সারা দেশেই তৃণমূল পর্যায়েও ইফতার মাহফিল ঘিরে ভোটের রাজনীতি চাঙ্গা থাকবে বলে দলটির নেতাকর্মীরা জানান।
সূচি অনুযায়ী প্রথম রোজায় এতিম ও আলেমদের সম্মানে, ৬ মার্চ কূটনীতিক এবং ৯ মার্চ রাজনীতিবিদদের সম্মানে পৃথকভাবে ইফতার মাহফিল হবে। পাশাপাশি আরও একটি ইফতার হবে কেন্দ্রীয়ভাবে (দিন চূড়ান্ত হয়নি)। এবার জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হলে তাদেরও স্বাগত এবং আমন্ত্রণ জানাবে দলটি। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডনে তার বড় ছেলের সঙ্গে এবারের ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এখনো বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথে সক্রিয় বিএনপি। পাশাপাশি দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে একাধিক ভার্চুয়াল বৈঠক করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সম্প্রতি যুগপৎ আন্দোলনের শরিক কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও ভার্চুয়ালি মতবিনিময় করেছেন তিনি। এ ছাড়া গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সহনীয় পর্যায়ে রাখা, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির দাবি, দ্রুত গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে উত্তরণের জন্য নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি এবং রাষ্ট্রে পতিত ফ্যাসিবাদের নানা চক্রান্তের অপচেষ্টা মোকাবিলাসহ বিভিন্ন জনদাবিতে বিএনপির উদ্যোগে সারা দেশে জেলা ও মহানগরে পর্যায়ক্রমে সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা রমজান শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলবে।
সূত্র জানায়, মার্চের শুরুতে রোজার মাস হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো নির্বাচনের রূপরেখা স্পষ্ট করেনি। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের আরও সক্রিয় এবং উজ্জীবিত রাখার লক্ষ্যে ভিন্ন কিছু কর্মসূচি নেওয়াটাই সমীচীন। সেজন্য আসন্ন রমজান মাস হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এই মাসে সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে ইফতার মাহফিলের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের আরও সক্রিয় ও সংঘবদ্ধ রাখতে পবিত্র রোজার মাসে সারা দেশে ইফতার মাহফিল আয়োজন করবেন সংশ্লিষ্টরা। গত বছরও সারা দেশে তৃণমূলে ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়েও ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছিলেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। সবমিলিয়ে প্রায় ১ হাজারের বেশি ইফতার মাহফিল করা হয়েছিল।
জানতে চাইলে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান গতকাল কালবেলাকে বলেন, প্রতি বছরই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগে ইফতার মাহফিল হয়। এবারও বিএনপির উদ্যোগে কেন্দ্রীয়ভাবে চারটি ইফতার মাহফিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জেনেছি।
বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের সক্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ রাখা বিএনপির অন্যতম টার্গেট। সেইসঙ্গে বরাবরের মতো এবারও গুম-খুনের শিকার নেতাকর্মীদের পরিবারে ঈদ উপহারসামগ্রী পাঠানো হবে। এ ক্ষেত্রে জুলাই অভ্যুত্থানের কিছু শহীদ পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকেও সহযোগিতা করার পরিকল্পনা আছে বিএনপির। এ বিষয়ে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’-এর আহ্বায়ক আতিকুর রহমান রুমন গতকাল কালবেলাকে বলেন, আমরা জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহযোগিতার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছি। বিষয়টি আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, রোজার মাসে সাধারণত মানুষ ধর্মকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। প্রায় প্রতি বছরই আমাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কয়েকটি ইফতার মাহফিল করে থাকেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। অতীতের ধারাবাহিকতায় অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও আমাদের ইফতার মাহফিলের আয়োজন থাকবে। সেটি কেন্দ্র থেকে তৃণমূলেও হবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন।
এদিকে কাউন্সিলের আদলে দীর্ঘদিন পর ঢাকায় বর্ধিত সভা ডেকেছে বিএনপি। আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি দলের এ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লা মেরিডিয়েন হোটেলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভা ডেকেছিলেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এর তিন দিন পর ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা নিয়ে কারাগারে যান। ওই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হয়ে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু পরে কারচুপির অভিযোগ এনে ভোটের ফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন করে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানায় তারা।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বর্ধিত সভার তারিখ ঘোষণা করে বলেন, ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে যারা দলের প্রার্থী ছিলেন এবং দলের টিকিট অর্থাৎ প্রার্থী নন; কিন্তু মনোনয়নের জন্য ‘সেকেন্ডারি’ কাগজ পেয়েছিলেন, তারাও বর্ধিত সভায় থাকবেন। এ ছাড়া বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য এবং জেলা কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, থানা-উপজেলা-পৌর কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবরা অংশ নেবেন বর্ধিত সভায়। বিএনপি ছাড়া ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরাও থাকবেন সেখানে।
এদিকে যুক্তরাজ্যে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঈদুল ফিতরের পর দেশে ফিরবেন। দেশে ফেরার দিনক্ষণ এখনো সুনির্দিষ্ট নয়। লন্ডন ক্লিনিকের চিকিৎসকরা বাসায় গিয়ে খালেদা জিয়ার নিয়মিত ফলোআপ করছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের সফরসঙ্গী ও উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী কালবেলাকে এমন তথ্য জানিয়ে বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। লন্ডনের বিশেষায়িত হাসপাতাল লন্ডন ক্লিনিকের লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জন প্যাট্রিক কেনেডির তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড যেদিন বলবে, সেদিনই তিনি দেশে ফিরবেন। খালেদা জিয়ার ১৫ সফরসঙ্গীর মধ্যে এরই মধ্যে আটজন দেশে ফিরেছেন। বাকিরা তার সঙ্গে ফিরবেন।