আওয়ামী লীগ নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ও আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করার দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। বৃহৎ দল বিএনপি, অন্যতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি ছাড়াও জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ফোরাম থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে সরকারের প্রতি চাপ বাড়াচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরাও আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে না বলে দফায় দফায় ঘোষণা দিচ্ছে। পাশাপাশি দলটির নিবন্ধন বাতিলের বিষয়েও আলোচনা চলছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে অবস্থান নেন। ওই সময় থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। মাঝখানে এ দাবি কিছুটা স্তিমিত থাকলেও সম্প্রতি সেটা আবার জোরালো হয়েছে। ছয় মাস ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিষয়টি নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক চলে আসার পর নতুন করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। পাশাপাশি বড় রাজনৈতিক দলগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বিএনপি আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ চায় না—কথাটি সত্য নয়। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে কি না, এ সিদ্ধান্ত জনগণকে নিতে হবে। রাষ্ট্র মিলে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান শনিবার এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে সব গণহত্যাকারী এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। জনগণ মনে করে, গণহত্যার অপরাধে অপরাধী হিসেবে আওয়ামী লীগের এ দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। এই জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের দাবির বিষয়টিও অন্তর্বর্তী সরকারকে বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।’
এদিকে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল না হলে জনগণের সামনে গভীর সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, কাজটি করতে না পারলে বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক ভিত্তি: জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। সভায় নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলে দেশের মানুষ যদি সচেষ্ট না হয়, তাহলে জনগণের সামনে গভীর সংকট অপেক্ষা করছে। এটি না করা হলে বাংলাদেশকে একটি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির এ আহ্বায়ক বলেন, ‘খুনের দায়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দ্রুতগতিতে তাদের (আওয়ামী লীগ) নিবন্ধন বাতিল করুন। আওয়ামী লীগের ব্যানারের বিষয়ে আগামী নির্বাচনের আগে যদি সমাধান না করা যায়, তাহলে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে ফেরার আর কোনো পথ থাকবে না।’
গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ মোহাম্মদ হাসানের জানাজা শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ দেখতে চাই। তিনি বলেন, দ্রুতগতিতে তাদের (আওয়ামী লীগ) নিবন্ধন বাতিল করুন।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের (এখন নিষিদ্ধ সংগঠন) ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ভাষণ দেন। এ ভাষণকে কেন্দ্র করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরসহ বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরের মধ্যে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ৩২ নম্বরের বাড়ি। তখন থেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আবার সরব হতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এর মধ্যে ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় কিছু নেতাকর্মীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা ও গণহত্যার বিচারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়। এমন প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ৭ ফেব্রুয়ারি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকার শিগগির পদক্ষেপ নেবে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়া ও খুনিদের বিচারের আগ পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ‘ব্যান আওয়ামী লীগ’ লেখা একটি পোস্ট দেন। এই পোস্টের আগে ওই দিন তিনি আরেকটি পোস্ট দেন। এর শেষ লাইনটি ছিল ‘ইন্টেরিম, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ কর, করতে হবে।’
এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও দলটির নিবন্ধন বাতিল চেয়ে গত ১৯ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করেন ‘সারডা সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠন। ২৭ আগস্ট সেই রিটের শুনানি হয়। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিহিংসার রাজনীতি করতে চাইবে—কেউ এটি প্রত্যাশা করলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, এই সরকার মনে করে, মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক দল অন্যতম প্ল্যাটফর্ম। পরে হাইকোর্ট আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও দলটির নিবন্ধন বাতিল চেয়ে করা রিটটি সরাসরি খারিজ করে দেন।
অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান। শুক্রবার সংবাদমাধ্যমে এক বিবৃতিতে তারা বলেছেন, ‘জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসরদের ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো তথ্য-প্রমাণসহ উঠে এসেছে। হাসিনার পরিকল্পনা ও নির্দেশে তার আজ্ঞাবাহী বাহিনীর সদস্যরা গুম-খুনে ও নির্যাতনে নৃশংসতার সব সীমা ছাড়িয়েছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ড, গুম-খুন, ৫ মে ও চব্বিশের গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। তা না হলে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ একদণ্ডও শান্তিতে থাকতে দেবে না, এ দেশের সরকার ও জনগণকে।’
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধি করার পক্ষে মত দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচারবিষয়ক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বলেছি, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এই মতাদর্শ ও এই নামে বাংলাদেশে আর রাজনীতি করতে পারবে না। এটিই আমাদের শহীদদের প্রতি অঙ্গীকার।’
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে গণঅধিকার পরিষদ কোনো আপস করবে না বলে মন্তব্য করেছেন দলের সভাপতি নুরুল হক নুর। শুক্রবার গণহত্যার বিচার ও গণহত্যাকারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধে ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধী বিক্ষোভ ও গণমিছিলে তিনি এ মন্তব্য করেন।
নুরুল হক নুর বলেন, ভোট ও নির্বাচন নিয়ে অনেকের যত কথা শোনা যায়, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে তত আওয়াজ শোনা যায় না। গত ৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে গণঅধিকার পরিষদ ডিসিদের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। ১২-১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদের আমলে ১৬ বছরের লুটপাটের বিচার দাবিতে লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ চলবে, ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলায় জেলায় বিক্ষোভ হবে।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি বন্ধের পক্ষে মত দিয়ে সম্প্রতি শেরপুরে এক অনুষ্ঠানে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করাসহ ভারতের স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি যারা করবেন, তাদের অবস্থা হবে ধানমন্ডি ৩২-এর মতো।’