ঢাকার মিরপুর-১৪ পুলিশ কমিউনিটি হলের পেছনের সড়কের পাশ ঘেঁষে সারি সারি ১৫ তলা ভবন নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশাল আবাসন প্রকল্প ‘বিজয় রাকিন সিটি’। ডেভেলপার কোম্পানি রাকিন ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড উন্নত বিশ্বের আদলে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতির প্রায় ৫০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছে এই কনডোমিনিয়াম আবাসন প্রকল্প, যেখানে প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম আকারভেদে দেড় থেকে চার কোটি টাকা পর্যন্ত। চুক্তি অনুযায়ী, প্রকল্পের মোট ফ্ল্যাটের ৪৩ শতাংশ সমিতির, বাকি ৫৭ শতাংশ ডেভেলপার কোম্পানির। সেই হিসাবে সমিতির নামে আছে ৮৭০টি ফ্ল্যাট, যার সবকটি পাওয়ার কথা সমিতির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের। তবে অভিযোগ উঠেছে, ৮৭০টি ফ্ল্যাটের অর্ধেকই রয়েছে প্রভাবশালীদের দখলে। এর মধ্যে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদুল আলম ও তার স্বজনদের নামেই আছে ৭০টি ফ্ল্যাট। এগুলো কবজায় রাখতে পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ প্রশাসনের অনেককেও তিনি ফ্ল্যাট দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৯৭ সালে ৪৯ জন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতি। পরে আরও ২৫১ জন সদস্য এতে যুক্ত হন। সমিতির সদস্যদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ২৩ নভেম্বর জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ মিরপুর-১৫ নম্বর এলাকায় ১৬.২ একর জমি বরাদ্দ দেয়। আবেদনপত্রে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা পল্লি প্রকল্প নাম দিয়ে ওই আবেদনে স্বাক্ষর করেন সমিতির উপদেষ্টা ও মুক্তিযোদ্ধা পল্লি প্রকল্পের আহ্বায়ক অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী এবং সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মোর্শেদুল আলম।
এর মধ্যে মোর্শেদুল আলম জোরজবরদস্তি করে এখনো সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদটি নিজের দখলে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া, শুধু পদ দখল করেই ক্ষান্ত হননি, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি, দলীয় নেতা ও প্রশাসনের সঙ্গে সখ্য আছে এমন ১১২ জনকে অবৈধভাবে সমিতির সদস্য বানিয়ে তাদের তিনি ফ্ল্যাট দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ থেকে প্রাপ্ত জমিতে আবাসনের জন্যে ২০০৮ সালে কনকর্ড কনডোমিনিয়মের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে সমিতি। তবে নানা কারণে এ চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। পরে রাকিন ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে ২০১০ সালের ৭ জুন ফের আবাসনের জন্যে একটি চুক্তি হয়। চুক্তিতে সই করেন সমিতির তৎকালীন সভাপতি এটিএম আহমেদুল হক চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদুল আলম। চুক্তি অনুসারে, পুরো প্রকল্পে ১ হাজার ৯৫০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করে তার ৪৩ শতাংশ হিসেবে সমিতিকে দেওয়া হবে ৮৭০টি ফ্ল্যাট। বাকি ১ হাজার ৮০টি ফ্ল্যাট পাবে নির্মাণ কোম্পানি রাকিন ডেভেলপমেন্ট। এ ছাড়া চুক্তি অনুযায়ী, সাইনিং মানি হিসেবে ১২ কোটি টাকা দেওয়া হয় সমিতিকে।
নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, চুক্তি অনুসারে ব্লক এ-টুতে ১০৮টি, এ-ফোরে ১০৮টি, এ-ফাইভে ১০৮টি, ব্লক এ-সেভেনে ৮৬টি, ব্লক বি-টুতে ১৫৯টি, বি-থ্রিতে ২১৪টি, বি-ফোরে ৮৭টি ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতির। এ ছাড়া চুক্তি অনুসারে আবাসন এলাকায় হাসপাতাল, স্কুল, মার্কেটসহ নানা স্থাপনার ভাগও পাবে সমিতি। তবে সমিতি তা পেলেও সমিতির সদস্যদের নামে তার সুষম বণ্টন হয়নি। আওয়ামীবিরোধী আখ্যা দিয়ে সমিতির অনেক সদস্যকেই বঞ্চিত করা হয়েছে। আর এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদুল আলমকে।
সমিতির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর সাধারণ সম্পাদকের পদে রয়েছেন মোর্শেদুল আলম। তার বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। কালবেলার হাতে আসা তথ্য বলছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় মোর্শেদুল আলমের বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। তবে এরপর নানা কায়দায় নিজের মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় তুলে ধরেন। বিষয়টি এক পর্যায়ে আদালতে গড়ায়, যা বর্তমানে বিচারাধীন।
বঞ্চিতদের অভিযোগ এবং কালবেলার অনুসন্ধান বলছে, নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে মুক্তিযোদ্ধাদের এই সম্পত্তিতে মোর্শেদুল প্রভাবশালীদের ভাগ দেওয়া শুরু করেন। এসব প্রভাবশালীর মধ্যে পতিত সরকারের মন্ত্রী ও এমপিসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও আছেন। এসব প্রভাবশালীর নামে প্রায় সাড়ে চারশ ফ্ল্যাট রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে কালবেলার অনুসন্ধানে প্রভাবশালীদের নামে প্রায় তিনশ ফ্ল্যাট থাকার তথ্য উঠে এসেছে।
প্রাপ্ত নথি বলছে, নামে-বেনামে ফ্ল্যাট পাওয়া প্রভাবশালীদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাবেক শেখ হাসিনার বাড়ির পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম, আলাউদ্দিন আহম্মেদ, সাবেক এমপি মুজিবনগর সরকার ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অর্থ সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা খন্দকার আসাদুজ্জামান, সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রী লুৎফুল আহমিনা খান, সাবেক এমপি কাজী ফিরোজ রশিদ, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান চৌধুরী, কামাল আহমেদ মজুমদারের ভাই আনোয়ার হোসেন মজুমদার, আওয়ামী লীগ নেতা খালিদ হোসেন ইয়াদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কাজী মেজবাউল হক সাচ্চু, সাবেক সচিব ও তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আবু তাহের, গোপালগঞ্জ শ্রমিক লীগের নেতা এমএম মিজানুর রহমান, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, বেনজির আহম্মদ, সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মীর সাহাবুদ্দিন ও পরিচালক মো. সাহেব আলী মৃধা, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জামাল মোস্তাফাসহ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, সচিব, অতিরিক্ত আইজিপি ও তাদের পরিবারের সদস্য।
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে নিজের ক্ষমতাবলে মোর্শেদুল ও তার স্ত্রী, ছেলে, ভাই-বোন, শাশুড়ি, শ্যালক, শ্যালিকার নামে ৭০টি ফ্ল্যাট দখলে নিয়েছেন। মোর্শেদুল আলমের স্ত্রী ফকির ফেরদৌসী বেগম দলিল নম্বর ১৩৯৬, ছেলে মোহাম্মাদ উল্ল্যাহ দলিল ১৪০৯, ভাই মাসুদ-ই আলম দলিল ১৩৯৪, ভাবি জরিনা বেগম দলিল ১৩৯৫, ভাতিজা আব্দুল্যাহ আল মামুন ১৩৯৭, তার স্ত্রী মনিরা বেগম লিলি দলিল ১৪০৪, ভাতিজির আমেনা আক্তার দলিল ১৪০২, ভাই মোছাদ্দেক আলম দলিল ১৩৯৯, ভাই এসএম আলশ হিরো, ভাতিজির জামাই মো. জহির দলিল ১৪২৭, বড় ভাই মো. মোখলেচুর রহমান দলিল ১৪২৪, ভাগিনা ড.মো. মোকাদ্দশ আলী ভূঁইয়া দলিল ১৪৭৩, ভাগ্নি সুরাইয়া খানম দলিল ১৬৭৫, ভাগিনা মোহাম্মাদ আলী ভূঁইয়া দলিল ১৪৫১, ভাতিজা মো. তোফাজ্জেল রহমান (রাসেল) দলিল ১৪৫২, ভাবি মর্জিনা, আক্তার পারুল দলিল ১৪২৬, ভাতিজা শেখ মো. মহিবুর রহমান দলিল ১৪২৫, শেখ মো. মোস্তাফিজুর রহমান দলিল ১৪৩৬, ভাতিজি মোহসিনা রহমান দিলল ১৪২৮, খালাতো ভাই সামশুজোহা চৌধুরী দলিল ১৬৮৫, শ্যালক ফজলুল করিম দলিল ১৪০৭. শাশুড়ি রাফিয়া খাতুন দলিল ১৪০৮, শ্যালিকা খাতিজা খাতুন ফকির ১৪০১, শ্যালিকা আয়েশা খাতুন ফকির ১৪০০, শ্যালিকা সুলতানা রাজিয়া ফকির ১৩৯৮, শ্যালকের স্ত্রী উম্মে হাবিবা ২০৪৯, ভাতিজি মাকসুদা খানম ১৪২৯, ভাবী ফয়জুন্নেছা আক্তার ১৪৩০, ভগ্নিপতি রফিকুল ইসলাম ১৪৩১, ভাগিনা নিয়ামুল হক ১৪৩৩, ভাতিজা আল্লামা শিবলী নোমান ১৪৩২, ভাতিজা শেখ আজিম উল্লাহ দলিল নম্বর ১৪৬৪। এদের প্রত্যেকের নামে দুইটি করে ফ্ল্যাট নিয়েছেন মোর্শেদুল আলম।
এ বিষয়ে কথা বলতে কয়েকদিন চেষ্টা করেও মোর্শেদুল আলমকে পাওয়া যায়নি। মিরপুরে তার বাসায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায়, ৫ আগস্টের আগে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় হওয়া একটি মামলায় কারাগারে আছেন তিনি।
এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতির সদস্য নঈম জাহাঙ্গীর, আব্দুর সাত্তার, আব্দুল কাদের, আব্দুল বারি, মোকলেছুর রহমান, মো. মকবুল হোসেন, মো. কামাল হোসেনসহ বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। তারা জানান, ১৯৯৯ সালের ২৩ নভেম্বর ৩০০ জন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নামে তালিকার হলফনামাসহ জাতীয় গৃহায়ন কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়। এরপর মন্ত্রণালয় ১৬.২ একর জমি বরাদ্দ দেয়। সেখানেই বিজয় রাকিন সিটি নামের আবাসন করা হয়েছে। কিন্তু নানা কায়দায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রশাসনের প্রভাবশালীদের নামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এমনকি সমিতির সাধারণ সম্পাদক সদস্যদের ফ্ল্যাট ক্ষমতার দাপটে পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের নামে লিখে নিয়েছেন। ৩০০ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই করে ১৬.২ একর জায়গা ও ফ্ল্যাট পুনরায় বণ্টনের দাবি জানান তারা।
মোর্শেদুল আলম কারাগারে যাওয়ার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন মো. বেলায়াত হোসেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ নেতা মোর্শেদুল আলম, রায়হান উদ্দিন আহমেদ ও আব্দুল্লাহ আল মামুন মিলে সমিতিকে বিতর্কিত করেছেন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের এই সমিতির সদস্য করা হয়েছে। বিএনপিমনা বলে দেড় শতাধিক তালিকাভুক্ত সদস্যকে ফ্ল্যাট বঞ্চিত করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নামের প্রায় সাড়ে চারশ ফ্ল্যাট সাধারণ সম্পাদক তার পরিবারের সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে দিয়েছেন।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. নূরুল বাসির কালবেলাকে বলেন, ‘আমার জানা মতে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতির মধ্যে ঝামেলা চলছে। এই সমিতির অবৈধ কোনো সদস্যের সঙ্গে যদি গৃহায়নের কোনো কর্মকর্তা জড়িত থেকে অনিয়ম করে এবং সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সার্বিক বিষয়ে রাকিন ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের কোম্পানি সচিব আবুবক্কর সিদ্দিক কালবেলাকে বলেন, এই প্রজেক্ট নিয়ে অনেক ঝামেলা চলছে। রাকিন সম্পূর্ণ নিয়ম মেনেই কাজ করে চলছে। ২০১০ সালে ৭ জুলাই এই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতির সঙ্গে চুক্তি হয় রাকিনের। চুক্তি অনুযায়ী ৪৩ ভাগ পাবে তারা। সেই অনুযায়ী মোট ৮৭০টি ফ্ল্যাট সমিতিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমিতি রাকিনের কাছে আর কোনো ফ্ল্যাট পাবে না।