ইউসুফ আরেফিন
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:১২ এএম
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:৫৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জনপ্রশাসনে ১১ সমস্যা

জনপ্রশাসনের সংস্কার চান ৮৪% মানুষ
জনপ্রশাসনে ১১ সমস্যা

জনপ্রশাসনে মোটাদাগে ১১টি সমস্যা চিহ্নিত করেছে এ সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন। শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা ও বিভিন্ন জরিপের ফল বিশ্লেষণ করে এসব সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি জনপ্রশাসন সংক্রান্ত দলিলাদি ও বই-পুস্তকও পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করেছে কমিশন।

এ ছাড়া দুর্নীতিমুক্ত দক্ষ জনপ্রশাসন গড়তে চান কি না—এমন প্রশ্নের জরিপে অংশ নেন প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার মানুষ। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই মনে করেন দেশের জনপ্রশাসন জনবান্ধব নয়। আর ৮৪ শতাংশ দেশের জনপ্রশাসন সংস্কার প্রয়োজন জানিয়ে তাদের মত দেন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করবে। সুপারিশের মধ্যে কোনগুলো স্বল্প মেয়াদে ও কোনগুলো দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়ন সম্ভব সেগুলো চিহ্নিত করবে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে সুপারিশ বাস্তবায়নের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সংস্কার কমিশনের চিহ্নিত করা জনপ্রশাসনের সমস্যাগুলো হলো—১. দুর্নীতি, ২. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ৩. অদক্ষতা ও আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ৪. স্বচ্ছতার অভাব, ৫. দুর্বল জবাবদিহিতা, ৬. সীমিত জনঅংশগ্রহণ, ৭. নিয়োগ ও পদোন্নতি ইস্যু, ৮. ওভারল্যাপিং (অর্থাৎ পদ ছাড়াই পদোন্নতি) এবং অপ্রচলিত ম্যান্ডেট, ৯. ধীরগতির সিদ্ধান্ত, ১০. সম্পদের অপব্যবহার ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং ১১. যথাযথ সমন্বয়ের অভাব।

এসব সমস্যা সমাধানে ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কমিশন। এগুলো হলো—১. গণমুখী জনপ্রশাসন, ২. স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, ৩. জনপ্রশাসনের দক্ষতা ও সক্ষমতা উন্নয়ন, ৪. নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন, ৫. জনপরিষেবায় সুনিপুণতা এবং ৬. কার্যকর জনপ্রশাসন। তবে এসব লক্ষ্য পূরণের পেছনে কিছু সমস্যা কাজ করছে। কমিশন তার প্রতিবেদনে সেসব সমস্যাও চিহ্নিত করেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনমুখী প্রশাসন গড়ার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা সীমিত জনঅংশগ্রহণ। এ সমস্যা সমাধানের জন্য নাগরিকদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অভিগম্যতা অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও উন্মুক্ত জনপ্রশাসন নির্মাণের অন্তরায় হিসেবে দুর্নীতি, দুর্বল জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার অভাবকে দায়ী করা হয়েছে। এ জন্য জবাবদিহিতা জোরদার করা, স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করার কথা বলা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের দক্ষতা ও সক্ষমতা উন্নয়নে বাধা হিসেবে নিয়োগ ও পদোন্নতি সংক্রান্ত সমস্যা এবং অদক্ষতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের মানোন্নয়ন করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া পেশাদারিত্ব নিশ্চিত ও সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলার সামনে বড় বাধা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। কমিশনের পরিচালিত জরিপে বলা হয়েছে, ৫৬ শতাংশ লোক মনে করে জনপ্রশাসনকে জনবান্ধব করার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। সুতরাং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত জনপ্রশাসন গড়তে আইনের শাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি পেশাদারিত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। দক্ষ পরিষেবায় সুনিপুণতা আনয়নের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রে অদক্ষতা, কার্য-সম্পাদন প্রক্রিয়া ও ধীরগতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়াই মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এজন্য সুনিপুণ জনপ্রশাসন গড়তে দক্ষ সেবা প্রদান, সেবাদান প্রক্রিয়া আরও সহজ করা এবং কর্ম-সম্পাদন ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে মুয়ীদ কমিশন।

কার্যকর জনপ্রশাসন গড়ার ক্ষেত্রে কাজের দ্বৈততা, সম্পদের অপব্যবহার, সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং যথাযথ সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এজন্য আন্তঃসংস্থা সমন্বয়, প্রযুক্তি গ্রহণ, নীতি বাস্তবায়ন এবং সেবাদান প্রক্রিয়া ডিজিটালি রূপান্তরের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।

জনপ্রশাসন নিয়ে নাগরিকদের ধারণা: কমিশন জনপ্রশাসন সংস্কার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে অনলাইনে নাগরিকদের মতামত সংগ্রহের জন্য এক জরিপ পরিচালনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১ লাখ ৫ হাজার নাগরিক বিভিন্ন প্রশ্ন সম্পর্কে তাদের অভিমত দেন। নির্ধারিত প্রশ্নের বাইরে উন্মুক্তভাবে মতামত দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়। সমগ্র জরিপের মানগত এবং সংখ্যাগত যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় দেশের ৮৪ দশমিক ৪০ শতাংশ নাগরিক মনে করেন দেশের জনপ্রশাসন সংস্কার প্রয়োজন। আর ৮০ শতাংশ মানুষের দৃষ্টিতে জনপ্রশাসন জনবান্ধব নয়। ৬৮ দশমিক ৮০ শতাংশ নাগরিকের ধারণা, গত ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে নিরপেক্ষতার অভাব ছিল। দলীয় লোক যেভাবে পদোন্নতি ও সেবা পেয়েছেন ভিন্নমতের মানুষজন সেভাবে পাননি। ৫৬ শতাংশ মানুষের মত হলো, জনপ্রশাসনকে জনবান্ধব করার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। এবং বাকি ৪২ শতাংশের মতে দুর্নীতিই হচ্ছে জনপ্রশাসনের প্রধান বাধা। ৫২ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রধান কাজ এবং ৩৬ শতাংশের মতে দুর্নীতি দূর করতে পারা হচ্ছে আসল কাজ। ৯৬ শতাংশের অভিজ্ঞতা হচ্ছে জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে। ৬৬ দশমিক ৪০ শতাংশ নাগরিক মনে করেন সরকারি কর্মচারীরা নাগরিকদের সঙ্গে শাসকের মতো আচরণ করেন এবং এর মধ্যে ৩১ শতাংশ জানান, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করেন। ৫২ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ঘুষ ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া যায় না। আর ৪৬ শতাংশের মতে সেবা চাইতে গিয়ে তারা হেনস্তার শিকার হয়েছেন। জরিপের মাত্র ৯৬ শতাংশই মনে করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ালেও ঘুষ-দুর্নীতি কমবে না। আর ৪ শতাংশের ভাষ্য, বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে ঘুষ-দুর্নীতি কমে যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন বিশ্লেষক ও সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার কমিশনের চিহ্নিত করা সমস্যাগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি, দুনীতি এবং দুর্নীতি। জনপ্রশাসনেও দুর্নীতি অন্যতম বড় সমস্যা বলে মনে করেন তিনি।

তবে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর কমিশনের বেশ কিছু সুপারিশ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন সাবেক এই সচিব। তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর, ভারত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সরকারি চাকরিতে এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস, এক্সিকিউটিভ ক্লাস বা এক্সিকিউটিভ গ্রুপ এক নম্বরে রয়েছে। এসব দেশের অগ্রগতি অর্জনের পেছনে আমলাতন্ত্রের ভূমিকাকে সম্মানের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়। সেখানে সেরাদের একটি অংশ এ সার্ভিসে যোগদান করে, সেখানেই চৌকস হিসেবে গড়ে ওঠে এবং ক্রমশ উঁচু পদে যায়। সেসব দেশে মাঝপথে কারও এখানে প্রবেশের সুযোগ নেই। সব সার্ভিসেই তিলে তিলে হাতেকলমে কাজ শিখে গড়ে উঠতে হয়। ওইসব দেশে তা করা হয়। আমাদের দেশে পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ, নিয়োগে কোটা, স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা প্রীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ একসঙ্গে বেশি সংখ্যায় নিয়োগের ফলে সব ওলট-পালট হয়ে গেছে বলেও মনে করেন সাবেক সচিব আব্দুল আউয়াল মজুমদার।

জনপ্রশাসনকে শক্তিশালী ও জনবান্ধব করতে দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যম মেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি সুপারিশ করে এ কমিশন। তবে প্রতিবেদনের বেশিরভাগ সুপারিশই বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা এ প্রতিবেদনের বেশ কিছু সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছে। আবার উপসচিব পুলে পদোন্নতিতে কোটা বাতিলের দাবি জানিয়েছে ২৫টি ক্যাডার। অন্যদিকে ৭৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ নামিয়ে আনায় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারও এ সুপারিশ মানবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। ফলে দুপক্ষের কোনো পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি মুয়ীদ চৌধুরীর কমিশন। এ নিয়ে প্রশাসনে হট্টগোল লাগার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঈদ বোনাসসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ

কুষ্টিয়ায় ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে সাব-রেজিস্ট্রার অবরুদ্ধ

পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন আন্তোনিও গুতেরেস

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈঠক

বাড়িতে একা পেয়ে সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণচেষ্টা, আটক ১

ইউরোপীয় দেশগুলোর বিরুদ্ধে ইউক্রেনে শান্তি প্রচেষ্টায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ

যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে দাবিনামার তালিকা পেশ রাশিয়ার

মুহূর্তেই শেষ পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনের ১৫ হাজার টিকিট

চাকরি দিচ্ছে রেড ক্রিসেন্ট, বেতন লাখের ওপরে

সাবেক এমপি আবু জাহিরসহ ৪০ জনের নামে মামলা

১০

দুপুরের মধ্যে দেশের যেসব জায়গায় বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে

১১

বিআরডিবির অর্থ কেলেঙ্কারি / আ.লীগ নেতার ১১ বছর জেল, জরিমানা ৩১ লাখ টাকা

১২

ট্রেনে ঈদযাত্রার অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু 

১৩

শুয়ে ফোন ঘাঁটছিলেন যুবক, তখনই হাজির চিতাবাঘ

১৪

এসির ভেতর বাসা বেঁধেছে সাপ, পরিষ্কার করতে গিয়ে হতবাক যুবক

১৫

কেমন থাকবে আজ ঢাকার আবহাওয়া

১৬

সোনারগাঁয়ে ‘পাঁচ’ বছরের শিশুকে ধর্ষণচেষ্টা, অভিযুক্তকে গণধোলাই

১৭

বায়ুদূষণে শীর্ষে দিল্লি, ঢাকার কী পরিস্থিতি?

১৮

১৪ মার্চ : ইতিহাসের এই দিনে যা ঘটেছিল

১৯

১৪ মার্চ : আজকের নামাজের সময়সূচি

২০
X