কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৪০ এএম
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:১৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঘর নিরাপদ নয়, আস্থা ব্যাংকের লকারেই

ঘর নিরাপদ নয়, আস্থা ব্যাংকের লকারেই

শামসুল ইসলাম রাজধানীর মতিঝিলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। গাইবান্ধার এই বাসিন্দা মানিকনগর এলাকায় নিজ ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। মূল্যবান জিনিসপত্র বাসায় রাখার ঝুঁকি এড়াতে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের একটি লকার নিয়েছেন তিনি। এর জন্য বার্ষিক গুনতে হচ্ছে ৪ হাজার ৬০০ টাকা।

জানতে চাইলে শামসুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছরই ঈদের সময় আমরা গাইবান্ধায় যাই। ২০১৮ সালে ঈদ শেষে বাসায় ফিরে দেখি দরজার তালা কেটে আমার স্বর্ণের গহনাসহ অনেক কিছু চুরি হয়ে গেছে। যদিও ওই সময় বেশিরভাগ গহনাই আমাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। এ জন্য নিরাপদ ভেবেই সোনালী ব্যাংক থেকে একটি লকার নিয়েছি। ৫ হাজার টাকা জামানত ও বার্ষিক নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে এই লকার পরিচালনা করতে হচ্ছে। এখন নিরাপদেই প্রতি বছর বাড়ি যেতে পারছি। বাসা নিয়ে খুব বেশি চিন্তায় থাকতে হয় না।

ধনীরা তো লকার সুবিধা নিচ্ছেনই, শামসুল ইসলামের মতো মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের মূল্যবান জিনিস ব্যাংকের লকারে জমা রাখছেন। তথ্য বলছে, ২০২২ সালের পর থেকে দেশের বিভিন্ন ব্যাংককে লকারের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে লকার ভাড়া নিয়ে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রাখছেন। আগে ছোট ও মাঝারি লকারের প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ ছিল বেশি। কিন্তু এখন গ্রাহকরা ছোট লকার ছেড়ে বড় লকার ভাড়া নিতে চাইছেন। সেই অনুযায়ী লকার সার্ভিস চালু করছে দেশের ব্যাংকগুলো।

জানা যায়, গ্রাহকরা মূলত মূল্যবান দলিল, কাগজপত্র, অলংকারসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংরক্ষণের জন্য লকার ব্যবহার করেন। তবে বর্তমানে বিদেশি মুদ্রা, স্বর্ণালংকারসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিসও লকারে রাখা হচ্ছে। তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, লকারে বিদেশি মুদ্রা রাখার কারণে দেশে ডলারের সংকট আরও তীব্র হতে পারে।

তথ্য বলছে, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, বসুন্ধরা, মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বড় লকারের চাহিদা বেড়েছে। ব্যাংকগুলো এই চাহিদা পূরণে সেবার পরিধি বাড়াচ্ছে এবং লকার সেবার জন্য নতুন চার্জও আরোপ করছে। উদাহরণস্বরূপ, আগে সোনালী ব্যাংক ছোট লকারের জন্য ২ হাজার টাকা, মাঝারি লকারের জন্য ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং বড় লকারের জন্য ৩ হাজার টাকা চার্জ ছিল। এখন ব্যাংকটি ছোট লকারে ২ হাজার ৮৭৫, মাঝারিতে ৩ হাজার ৪৫০ এবং ছোট লকারে ৪ হাজার ৬০০ চার্জ নিচ্ছে। আর জামানত রাখা হয় ৫ হাজার টাকা। বেড়েছে অন্যান্য ব্যাংকের লকার ভাড়াও। যদিও ব্যাংকগুলো বলছে, ব্যাংকের খরচ বাড়ার কারণেই লকার খরচ বাড়ানো হয়েছে।

কোন ব্যাংকে লকার খরচ কেমন: দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের বেশিরভাগ ব্যাংকই তিন ধরনের লকার সুবিধা দিয়ে থাকে—ছোট, মাঝারি ও বড় লকার। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রূপালী ব্যাংকে ছোট লকারে ২ হাজার ৩০০, মাঝারি লকারে ৩ হাজার এবং বড় লকারে ৩ হাজার ৭০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। আর জামানত হিসেবে ২ হাজার টাকা এককালীন নিচ্ছে ব্যাংকটি। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকে ছোট ২ হাজার, মাঝারিতে ২ হাজার ৫০০ এবং বড় লকার ভাড়া ৩ হাজার টাকা। জনতা ব্যাংকের ছোট লকারে ২ হাজার, মাঝারিতে ৩ হাজার ও বড় লকার ভাড়া ৫ হাজার টাকা। ব্যাংক দুটিতেই জামানত হিসেবে জমা রাখতে হয় ৫ হাজার টাকা।

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে লকার ভাড়া সবচেয়ে কম গুনতে হয় আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের। ব্যাংকটির ছোট লকারে ২ হাজার, মাঝারিতে ২ হাজার ৫০০ এবং বড় লকারের ভাড়া ৩ হাজার ৫০০ টাকা। তবে এক্ষেত্রে জামানত হিসেবে রাখতে হয় যথাক্রমে ১০, ১২ ও ১৫ হাজার টাকা। আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের মোট ২৩টি শাখা লকার সুবিধা দিয়ে থাকে। এসব শাখায় মোট ২ হাজার ২৮টি লকার আছে। এর মধ্যে ছোট ৭৩৮টি, মাঝারি ৯৯৩টি এবং বড় লকারের সংখ্যা ২৯৭টি।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ছোট লকারে ৩ হাজার ৫০০, মাঝারি লকারে ৪ হাজার ৬০০ এবং বড় লকারে ৬ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা। এর সঙ্গে পরিধি অনুযায়ী সমান জামানত রাখছে ব্যাংকটি। সমান চার্জ নিচ্ছে শাহাজালাল ইসলামী ব্যাংকও। তবে ব্যাংকটি জামানত হিসেবে ৫ হাজার এবং চাবির জন্য চার্জ নির্ধারণ করেছে ৩ হাজার টাকা। প্রচলিত ধারার সিটি ব্যাংক ছোট লকারে ৫ হাজার ৫০০, মাঝারি লকারে ৭ হাজার ৫০০ এবং বড় লকারে ৯ হাজার ৫০০ টাকা চার্জ নির্ধারণ করা। পূবালী ব্যাংক ছোট লকার ২ হাজার ৫০০, মাঝারিতে ৩ হাজার এবং বড় লকারের চার্জ ৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা। ডাচ বাংলা ব্যাংক ছোট লকারে ৫ হাজার, মাঝারি লকারে ৭ হাজার এবং বড় লকারে ১০ হাজার টাকা চার্জ নিয়ে থাকে।

প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংকের লকার সার্ভিসে বিভিন্ন ধরনের চার্জ নির্ধারণ করা আছে। ব্যাংকটির ছোট, মাঝারি ও বড় ক্যাটাগরির লকারেও আছে রেগুলার ও প্রিমিয়াম সার্ভিস। আছে শহর ও গ্রামের মধ্যে তারতম্যও। ইবিএলের রেগুলার ক্যাটাগরিতে লকার নিতে হলে ছোট লকারে বার্ষিক ৫ হাজার ১৭৫, মাঝারিতে ৬ হাজার ৩৮ এবং বড় লকারে ৮ হাজার ৬২৫ টাকা গুনতে হবে। আর প্রিমিয়াম ক্যাটাগরিতে লকার নিতে হলে ছোট লকারে, ৭ হাজার ৭৬৩, মাঝারিতে ৯ হাজার ৪৮৮ এবং বড় লকার নিতে গুনতে হবে ১৩ হাজার ৮০০ টাকা।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, গুলশান, বনানী, উত্তরা ও ধানমন্ডি এরিয়ায় আমাদের লকারের চাহিদা বেশি। তবে বনানী ছাড়া অন্য জায়গায় বড় লকারের চাহিদা রয়েছে। এরিয়া অনুযায়ী লকারের চাহিদার ভিন্নতা আছে বলে জানান তিনি।

মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, লকারে কোন গ্রাহক কী রাখেন সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ওই এরিয়ায় কোনো ধরনের সিসি টিভি বা নজরদারি থাকে না। যদি কোনো গ্রাহক ১০ বছরের বেশি সময় লকার সংক্রান্ত কোনো খোঁজ বা যোগাযোগ না রাখেন, তাহলে আমরা তার ঠিকানায় যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। যদি কোনো রেসপন্স না পাই তাহলে লকারের সম্পদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিই।

এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বড় লকারের চাহিদা অনেক বেড়েছে। আগে ছোট ও মাঝারি লকারের চাহিদা বেশি ছিল। আর লকারের চাহিদা আগের তুলনায় বেশি। তিনি আরও বলেন, গ্রাহক লকারে কী রাখছেন, সেটি ব্যাংকের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে নীতিমালা হলো, লকারে থাকা জিনিসপত্রের দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের। এখন গ্রাহক যদি আইনে অনুমোদিত নয় এমন সব জিনিসপত্রও লকারে রাখেন তাহলে ব্যাংকারদের কিছু করার নেই। এই লকার গ্রাহক বা ব্যাংকার একা খোলার কোনো সিস্টেম নেই। দুজনের চাবি ব্যবহার করেই লকার খুলতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের লকার সুবিধা: বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কর্মকর্তার জন্যই লকার বরাদ্দ রয়েছে। কোনো কর্মকর্তার লকার দরকার হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের অন্তর্গত লকার বিভাগে আবেদন করতে হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে এসব লকারে সম্পদ রাখেন কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সামনে সম্পদ রেখে লকার সিলগালা করা হয়। পরে কোনো কর্মকর্তা লকার খোলার জন্য আবেদন করলে তিনি এই লকার খুলতে পারেন। তবে কোনো লকার ২০ বছরের বেশি অদাবিকৃত থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই লকার খুলে সম্পদ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে পারবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা কালবেলাকে বলেন, লকার সেবার যাবতীয় দায়দায়িত্ব গ্রাহকের। সেখানে তিনি কী রাখবেন বা না রাখবেন তার দায়দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। এর জন্য ব্যাংকের কোনো দায় নেই। তবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি প্রয়োজন মনে করে, তারা আদালতের অনুমতি নিয়ে লকার খুলতে পারে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যুক্তরাষ্ট্রে বিমান-হেলিকপ্টার সংঘর্ষের ঘটনায় ট্রাম্পের বিবৃতি

ওয়াশিংটনে বিমান-হেলিকপ্টার সংঘর্ষে ১৮ মরদেহ উদ্ধার

দুই বিভাগে বৃষ্টির সম্ভাবনা, বাড়বে তাপমাত্রা

সুযোগ পেয়েও ইমনের মেডিকেলে ভর্তি হওয়া অনিশ্চিত

শীতে কাবু কুড়িগ্রামের মানুষ, বিপর্যস্ত জনজীবন

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশ / মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেন তাঁবুতে থাকা সেই বাদশা 

বিদেশি নাগরিকসহ আট জিম্মিকে মুক্তি দিচ্ছে ফিলিস্তিনিরা

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মসূচির প্রতিবাদে ঢাকা কলেজে বিক্ষোভ 

ঢাকার বাতাস আজও ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বের হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্র

১০

জবিতে ২ শিক্ষার্থীর ওপর হামলা, ছাত্রফ্রন্টের নিন্দা

১১

মতলব উত্তর আ.লীগ নেতা শাহজাহান গ্রেপ্তার

১২

মাঝ আকাশে বিমান-হেলিকপ্টারের সংঘর্ষ, বহু হতাহতের আশঙ্কা

১৩

ডিএমপির অভিযানে গ্রেপ্তার ২২

১৪

শৈত্যপ্রবাহের কবলে পঞ্চগড়, তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রির ঘরে

১৫

সিরিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হলেন বিদ্রোহী নেতা

১৬

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মসূচির প্রতিবাদে যবিপ্রবিতে মশাল মিছিল 

১৭

ওয়ার্ল্ড ভিশনে চাকরির সুযোগ

১৮

ছাত্রলীগ সন্দেহে ৬ যুবককে পুলিশে সোপর্দ

১৯

সিরিয়ায় আসাদের দল বাথ পার্টি বিলুপ্ত ঘোষণা

২০
X