পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর পোশাক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে গোপন ভোটের মাধ্যমে সরকারের এই তিনটি বাহিনীর সদস্যদের পোশাকের রং ঠিক করা হয়েছে। পুলিশের পরিবর্তিত পোশাক হবে লোহার (আয়রন) রঙের। র্যাবের পোশাক হবে জলপাই (অলিভ) রঙের। আর আনসারের পোশাক হবে সোনালি গম (গোল্ডেন হুইট) রঙের।
বৈঠক সূত্র জানায়, মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দমন-পীড়নের অভিযোগ ওঠায় পুলিশ ও র্যাবের প্রতি সাধারণ মানুষের যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তা দূর করতেই আপাতত পোশাক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গতকাল সোমবার আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ( অব.)। তিনি আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির আহ্বায়ক। তিনিসহ ১১জন উপদেষ্টা এই কমিটির সদস্য।
সূত্র জানায়, বৈঠক শুরুর আগে বিভিন্ন পোশাকে ১৮ জন পুলিশ, আনসার ও র্যাব সদস্য বৈঠকে প্রবেশ করেন। কিন্তু কার জন্য কোন রঙের পোশাক হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন মতামত আসে। কেউই একমত হতে পারছিলেন না। পরে সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের গোপন ভোটের মাধ্যমেই পোশাকের রং নির্বাচন করা হবে। সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটে পুলিশের জন্য পোশাক নির্বাচন করা হয়। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটের ফলাফলে র্যাবের পোশাক এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোটে আনসারের পোশাক নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ ১৮টি পোশাক থেকে তিনটির পক্ষে বেশি ভোট পড়ে। এরপর তিনটি পোশাক অনুমোদন দেয় আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি।
দখলবাজি ও চাঁদাবাজি বেড়েছে:
বৈঠক সূত্র জানায়, সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিবিষয়ক আলোচনা, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও দখলবাজি নিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা আলোচনা করেন। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, সারা দেশে দখলবাজি ও চাঁদাবাজি বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দখল ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারছে না। এ নিয়ে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা দখলবাজিতে যুক্ত হয়েছেন বলে বৈঠকে জানানো হয়। এসব চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্য শক্তহাতে প্রতিহত করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শীর্ষ মাদক কারবারি ও সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরও হত্যাসহ একাধিক মামলা হওয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ‘পিচ্চি হেলাল’ ও ইমনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান রেজাউল করিম মল্লিক। গত ১৪ জানুয়ারি ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মাথাচাড়া দেওয়ার কথাও স্বীকার করেন তিনি।
কেনা হবে অপ্রাণঘাতী অস্ত্র :
পুলিশ ও সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ব্যবহারের জন্য অপ্রাণঘাতী ( নন-লেথাল) অস্ত্র কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ইত্যাদি অপ্রাণঘাতী অস্ত্র। এসব অস্ত্র ব্যবহারের ফলে কারও মৃত্যু হওয়ার ঝুঁকি কম।
সূত্র জানায়, শুধু বিজিবির জন্যই নয়, পুলিশের জন্যও অপ্রাণঘাতি অস্ত্র কেনার বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে। আপাতত পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র দিতে চায় না সরকার।
অবৈধ অভিবাসী সাড়ে ৩৩ হাজার :
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, বাংলাদেশে অনেকে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৪৯ হাজার ২২৬। সেটি কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৬৩৮। বৈধ হওয়ার আবেদন থেকে ১০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। যারা অবৈধ অভিবাসীদের থাকতে সহায়তা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বৈঠকের আলোচ্য সূচিতে আরও যা ছিল :
মাদকের অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ এসেছে বৈঠকে। মাদক কারবারিদের তৎপরতা বেড়েছে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। শীর্ষ মাদক কারবারিদের ধরতে গ্রেপ্তারে আরও কঠোর অভিযানের দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনগুলোর অপতৎপরতা রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আরও সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব এজতেমার আয়োজন নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে বিরোধের পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেদিকে নজর রাখছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসন। পুলিশপ্রধান ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা ইজতেমা নিয়ে ফের হামলা-সংঘর্ষের আশঙ্কা করেছেন।
অস্ত্র জমা ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান নিয়ে বৈঠকে কথা বলেছেন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পুলিশ মহাপরিদর্শক ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা। দ্রুত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করার বিষয়ে তা কাজ করছেন বলে জানান। অবৈধ অস্ত্র নিয়ে উদ্বেগের কথাও জানিয়েছেন কমিটির সদস্যরা।
আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় অন্যান্যের মধ্যে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, র্যাবের মহাপরিচালক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।