দেশের আলোচিত ১০ শিল্প গ্রুপের অর্থ পাচার তদন্তের উদ্যোগ শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। তদন্তের জন্য গঠিত যৌথ অনুসন্ধান কমিটিগুলো বাতিল করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সমন্বয়ে গঠিত এই দশটি তদন্ত কমিটি বাতিল করে সম্প্রতি এনবিআরকে চিঠি পাঠিয়েছে বিএফআইইউ।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ধারা ৯(১) এবং ২০১৯ সালের বিধিমালা অনুসারে যৌথ অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়েছিল। বিএফআইইউর যুগ্ম পরিচালক মোসাম্মৎ ফুয়ারা খাতুন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে দলগুলো বাতিলের কারণ ব্যাখ্যা করে জানানো হয়, বিষয়টি নতুন করে রিভিউ করা হচ্ছে।
সরকার দেশে আলোচিত ১০টি শিল্প গ্রুপের অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে এই দলগুলো গঠন করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রুপগুলো হলো আরামিট, এস আলম, বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, শিকদার, সামিট, ওরিয়ন, জেমকন, নাসা ও নাবিল গ্রুপ।
তদন্তে এসব গ্রুপের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বেআইনি লেনদেন, কর ফাঁকি এবং বিদেশে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছিল।
তদন্ত বাতিলের কারণ এবং পরিবর্তন: যৌথ অনুসন্ধান দলের কাজ বন্ধ হওয়ার কারণ নিয়ে কিছুটা ভিন্নমত দেখা গেছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, ‘যৌথ তদন্ত কমিটি বাতিল করা হয়নি; বরং নেতৃত্ব দেওয়া সংস্থা পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।’ তদন্ত কমিটি বাতিলের কারণ সম্পর্কে বিএফআইউর প্রধান শাহীনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, যৌথ অনুসন্ধান সংক্রান্ত্র কমিটি বাতিলের বিষয়টি আমিও শুনেছি। এখনো সঠিক বলতে পারছি না। আমি সবে বিএফআইতে যোগ দিয়েছি।
যৌথ অনুসন্ধান কমিটি বাতিল সম্পর্কে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আগের যৌথ তদন্ত কমিটি বাতিল করা হচ্ছে না। মূলত লিড এজেন্সি বা নেতৃত্ব দেওয়া সংস্থা পরিবর্তন করা হচ্ছে। কিন্তু বিএফআইইউর পাঠানো চিঠিতে স্পষ্টত বলা হয়েছে, তদন্ত কমিটি বাতিল করা হয়েছে। সূত্রমতে, লিড এজেন্সির পরিবর্তনের পাশাপাশি তদন্ত কার্যক্রম নতুন কাঠামোতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানের ফল: তদন্তের আওতায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো ও তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কিছু গুরুতর তথ্য পাওয়া গেছে। ১. বেআইনি ব্যাংক লেনদেন এবং সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য। ২. বিদেশে সম্পদ অর্জনের তথ্য। ৩. সরকারি রাজস্ব ফাঁকি এবং অবৈধ সম্পদ। ৪. ব্যাংক ঋণের অপব্যবহার।
তদন্তে পাওয়া এসব তথ্যের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এরই মধ্যে ফ্রিজ করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে তাদের অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহে চিঠি পাঠানো হয়েছে এবং কিছু তথ্যও পাওয়া গেছে।
তদন্ত কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ভূমিকা: প্রথমে তদন্ত কমিটিগুলোর নেতৃত্বে ছিল দুটি সংস্থা। দুদক ছিল ছয়টি গ্রুপের দায়িত্বে। সিআইডি ছিল চারটি গ্রুপের দায়িত্বে। এ ছাড়া এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) এবং শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ সহযোগী সংস্থা হিসেবে কাজ করছিল। এবার নতুন কাঠামোয় এসব সংস্থার ভূমিকা কী হবে, তা পুনর্গঠনের পর জানা যাবে।
অর্থ পাচারের পরিণতি এবং উদ্বেগ: প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, এই শিল্প গ্রুপগুলো ব্যাংক দখল, ঋণ জালিয়াতি এবং অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। তাদের সম্পদ, ঋণ ব্যবহারের খাত এবং ব্যবসায়িক লেনদেনের বিস্তারিত খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, কানাডা এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে তথ্য চাওয়া হয়েছে।
যৌথ তদন্ত কমিটি বাতিল হলেও অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান বন্ধ হয়নি। বরং নতুন কাঠামোয় কার্যক্রম চালানোর পরিকল্পনা চলছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সঠিকভাবে পরিচালিত হলে এই উদ্যোগ দেশের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবং প্রভাবশালী অর্থ পাচারকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।