উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়েও ওষুধ, এলপি গ্যাস, মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবাসহ ৬৭ পণ্য ও সেবায় শুল্ক, কর, ভ্যাট বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ ছাড়া বার্ষিক টার্নওভারের সীমা কমিয়ে আনায় খড়্গ নেমে আসবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়। এ ছাড়া বছরের মাঝপথে শুল্ক-কর বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলেও অভিহিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে নাগরিক কমিটি এই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিও জানিয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরেই দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন ঘটেছে। কখনো খাদ্যে, কখনো বা খাদ্যবহির্ভূত খাতে, কখনো আবার সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়েছে দুই অঙ্কের ঘর। এ পরিস্থিতিতে শুল্ক-কর ও ভ্যাট বাড়াতে সার্বিক অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে। এই পরোক্ষ করে চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। আর ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আরও চাপে পড়বে অর্থনীতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে সরকার রাজস্ব ফাঁকি বা বকেয়া আদায়ের কঠিন পথ না বেছে শুল্ক-কর বাড়ানোর সহজ পথ বেছে নিয়েছে। আর এই পদক্ষেপে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, যেসব পণ্যে ট্যাক্স বেড়েছে, সেগুলোর দাম তো বাড়বে। প্রভাব পড়বে না বলা হলে, বোধ হয় তা বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়। তিনি আরও বলেন, ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) অনুযায়ী, এসব পণ্যের ওজন কম, দর কম, সেজন্য হয়তো মূল্যস্ফীতির হারের ওপর খুবই কম প্রভাব পড়বে। যেসব পণ্যের দাম বাড়ানো হলো, অধিকাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে যেগুলো ১৫ শতাংশের নিচে ছিল, সেগুলোকে ১৫ শতাংশে উঠানো হয়েছে। তার মানে ভ্যাট রেইট ইউনিফিকেশন (একীভূতকরণ), মানে সব পণ্যে একই ভ্যাট হবে, এটা তো একটা নীতি ছিল সরকারের। শুল্ক ও কর বাড়ানোর জন্য এই সময়টাকে যথোপযুক্ত মনে করছেন না এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এখানে সময়টি প্রশ্নবিদ্ধ। যদি, একীভূত করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, সেটা তো আগামী বাজেটে করা যেত বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১০টার একটু আগে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং দ্য এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ নামে এ দুটি অধ্যাদেশ জারি করে এনবিআর। তার আগে ১ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে এনবিআরের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। অধ্যাদেশ জারির পরপরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে; এতে তা সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয়ে গেছে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও এনবিআর দাবি করেছে, এতে ভোক্তার বাড়তি মূল্য গুনতে হবে না। তবে বাস্তবে অনেক পণ্যে ও সেবার দাম বাজারে বেড়ে গেছে। শুল্ক-কর বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা দাবি করেছিলেন, এ পদক্ষেপে নিত্যপণ্যের বাজারে প্রভাব পড়বে না। এনবিআরও একই সুরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে দাবি করেছিল, মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে না।
যা বলছেন রাজনীতিবিদরা: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবাসহ শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক, কর, ভ্যাট বাড়িয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জারি করা দুটি অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের চুক্তির শর্ত পুনর্বিবেচনা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। গতকাল শনিবার রাজধানীর বাংলামটর জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এই দাবি জানান সংগঠনটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য করের আওতা বাড়াবে এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া; কিন্তু কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যাতে নেমে না যায় ও তাদের ভোগান্তি যাতে না বাড়ে, সে বিষয়টি সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, বিগত অবৈধ সরকারের গণবিরোধী লুটেরা অর্থনৈতিক নীতি ও বিদেশে সীমাহীন অর্থপাচারের ফলে সাধারণ মানুষ ও মধ্যবিত্তের জীবন ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে।
এর আগে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছেন, সরকার সাধারণ মানুষের ওপর পরোক্ষ কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেমন, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য বিস্কুট, সাধারণ হোটেল, মোবাইল রিচার্জ, গ্যাসসহ অপরিহার্য পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। যা সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলবে।
জনমনে ক্ষোভ ও নানা প্রশ্ন
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে কথা হয় বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা তাহমিদের সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, সরকার খালি কর বাড়ানোর তালে আছে, আয় বাড়ল কি না, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। একে তো মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের নিচে নামে না, এর মধ্যে আবার এই ভ্যাট বাড়ানোতে অবশ্যই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এতে চাপ তো আরও বাড়বে। রাজধানীর ধানমন্ডিতে কথা হয় দেশের নামকরা একটি আবাসন কোম্পানির কর্মী সাজিদ হাসানের সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, ভ্যাট বাড়ানো সরকারের একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। সরকার রাজস্ব বাড়াতে চায়, ভালো কথা; কিন্তু সেটা বাজেটে করা যেত। এমনিতেই দীর্ঘ দিন ধরে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের চাপে মানুষ পিষ্ট। এখন এই ভ্যাট বাড়ানোর কারণে আবার নতুন করে কিছু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে।