ওমর ফারুক নাঈম, মৌলভীবাজার
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০৯ এএম
আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চা শ্রমিক

যারা মুখে তুলে দেয় স্বাদ তাদের জীবনই তেতো

যারা মুখে তুলে দেয় স্বাদ তাদের জীবনই তেতো

চা শ্রমিক দম্পতি শীত কুমার রিকিয়াসন ও যমুনা রিকিয়াসন। তাদের তিন সন্তান; তিনজনই মেয়ে। শীত কুমার কাজ করেন শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও চা বাগানে। ১৫ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৬ ফুট প্রস্থের একটি ঘরের এক পাশে মাটির ওপর পাটি বিছিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন সবাই। অন্যপাশে থাকে তাদের পালিত গরু। গরু রাখার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৪ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৩ ফুট প্রস্থের জায়গা। তার পাশেই পানির পাত্র আর রান্নার জন্য দু-তিনটি হাড়িপাতিল। ঘরে উল্লেখ করার মতো আসবাব বলতে আছে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার।

শীত-যমুনারা এভাবেই বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকাটাই তাদের জীবন। শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। চা বাগানের শ্রমিক হওয়ার জন্যই যেন তাদের জন্ম। মা-বাবা বাগানে কাজ করেন, তারপরে সন্তানরা। এভাবে বংশপরম্পরায় চায়ের সঙ্গেই কেটে যায় তাদের পুরোটা জীবন। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে যে অন্য পেশায় পাঠাব, সেই সামর্থ্য বা ক্ষমতাও নেই। তাদের আক্ষেপ, শ্রম আইন ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির শর্তগুলো সঠিকভাবে মানা হয় না। সময়মতো চুক্তিও সম্পন্ন হয় না।

সূর্য ওঠার আগেই উঠতে হয় চা শ্রমিকদের। একমুঠ মুড়ি আর এক কাপ চা খেয়ে কাজে নেমে পড়েন তারা। রোদ-বৃষ্টি যাই হোক, দিনভর সংগ্রহ করেন চা পাতা। দুপুরে এক ফাঁকে চা পাতার চাটনি মেখে খান ভাত, কখনো সঙ্গে থাকে মুড়ি কিংবা চানাচুর। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে ভিজে, খালি পায়ে, জোঁক আর বিষাক্ত সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে চা বাগানকে আঁকড়ে জীবন পার করছেন তারা। জীবনভর আটকে থাকছেন সবুজ কুঁড়িবেষ্টিত চা বাগানের সীমানাতেই। বংশপরম্পরায় যে জমিতে চা শ্রমিকরা বসবাস করেন, সেই জমির ওপর কখনোই মেলে না অধিকার। তাই মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু ধরে রাখতে হলে পরিবারের কাউকে না কাউকে বাগানে কাজ করতেই হয়। দিনশেষে ২৩ কেজি পাতা তুললে তবেই পূরণ হয় মাথাপিছু লক্ষ্যমাত্রা। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেই কেবল ‘হাজিরা’ হিসেবে গণ্য করা হয়। গাছ ছাঁটার সময় সারা দিনে অন্তত ২৫০টি চা গাছ ছাঁটতে হয়। কীটনাশক ছিটানোর বেলায় সারা দিনে অন্তত এক একর জমিতে কীটনাশক ছিটানোর লক্ষ্যমাত্রার বোঝা কাঁধে নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। প্রত্যেক বছর শ্রমিক দিবস এলে ঘটা করে পালন করা হয় দিনটি। কিন্তু চা বাগানের শ্রমিকরা তাদের জীবনচক্র আটকে ফেলেছেন চা বাগানের গণ্ডির মধ্যেই। এই সময়ে দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, দেশে অনেক পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসেনি দরিদ্র চা শ্রমিকদের। চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদ (বিটিএ) ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে মজুরি নির্ধারণ করা হয়। প্রতি দুই বছরের জন্য এ চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দৈনিক ১১৭-১২০ টাকা করা হয়। পরে ২০২২ সালে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মজুরি ৫০ টাকা বাড়িয়ে ১৬৮-১৭০ টাকা নির্ধারণ হয়। সেটি কার্যকর হয় ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি। বর্তমানে প্রথম শ্রেণির বাগানের শ্রমিক দিনে ১৭০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণির বাগানের শ্রমিক ১৬৯ ও তৃতীয় শ্রেণির বাগানের শ্রমিক ১৬৮ টাকা মজুরি পান।

চা শ্রমিক ইউনিয়ন বালিশিরা ভ্যালির সভাপতি বিজয় হাজরা বলেন, সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর। দুই বছর পার হতে চলছে, এখনো নতুন চুক্তি হয়নি। আর বালিশিরা ভ্যালি ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক কর্ণ তাঁতি বলেন, স্থায়ী চা শ্রমিকরা সব কাজেই পান ১৭০ টাকা। অস্থায়ী চা শ্রমিকরা শুধু পাতা তোলার জন্য ১৭০ টাকা আর অন্য কাজের জন্য ১২০ টাকা বা এর কম পান। আমরা বারবার প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয়নি। যুগ যুগ ধরে কাজ করেও আমরা চা শ্রমিকরা বসতঘরের নিশ্চয়তা পাই না।

বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রি বুক ২০১৯-এর তথ্যমতে, দেশের ১৬৮টি চা বাগানে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭। অস্থায়ী চা শ্রমিকের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৪৩৭ এবং চা জনগোষ্ঠীর মানুষ ৪ লাখ ৭২ হাজার ১২৫ জন। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্যানুযায়ী, এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে অনিয়মিত ও বেকার শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। আর চা জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। তাদের দুই-তৃতীয়াংশ মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানে বসবাস করেন। দেশে যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ম্যালেরিয়া ও জরায়ু ক্যান্সারের প্রবণতা চা শ্রমিকদের মধ্যে বেশি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। মৌলভীবাজার জেলায় প্রতি বছর যে পরিমাণ যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়, এর অন্তত ৩৬ শতাংশ চা জনগোষ্ঠীর মানুষ।

মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় গত চার বছরে ১৯ হাজার ৯১৪ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়। এর মধ্যে শুধু চা বাগানের বাসিন্দা ৭ হাজার ২২০ বা ৩৬ শতাংশের বেশি। কুষ্ঠ রোগের চিত্রটা আরও ভয়াবহ। গত চার বছরে মৌলভীবাজারে ৭৬১ কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হয়। এর মধ্যে ৬৩১ জনই চা বাগানের বাসিন্দা। মোট শনাক্তের ৮৩ ভাগই চা জনগোষ্ঠীর মানুষ।

২০১৯ সালে সিলেট অঞ্চলের চা বাগানগুলোর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রথমবারের মতো জরিপ চালায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। জরিপের তথ্যানুযায়ী, অপুষ্টির কারণে চা বাগানের ৪৫ শতাংশ শিশুই খর্বকায়। ২৭ শতাংশ শীর্ণকায়। স্বল্প ওজনের শিশু ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তা ছাড়া ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ৪৬ শতাংশ কিশোরীর এবং মা হয়ে যাচ্ছে ২২ শতাংশ। এ ছাড়া ন্যূনতম স্যানিটেশন সুবিধা নেই ৬৭ শতাংশ পরিবারের। ২০১৮ সালে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) গবেষণা করে জানায়, মৌলভীবাজারে চা বাগানের প্রায় ১৫ শতাংশ নারী জরায়ু ক্যান্সারে ভুগছেন।

মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. মামুনুর রহমান বলেন, অনুন্নত জীবন ও পরিমিত খাবারের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগেন চা শ্রমিকরা। এ কারণে তাদের মধ্যে যক্ষ্মা, কুষ্ঠ রোগের হার তুলনামূলক বেশি। তা ছাড়া কোনো রোগ হলে তারা সহ্য করে চাপিয়ে রাখেন। অসহ্য না হলে চিকিৎসকের কাছে আসেন না। কারণ ওই দিনের মজুরি পাওয়া যাবে না এই ভয়ে। যার কারণে তাদের রোগ শনাক্ত হয় অনেক দেরিতে, যখন খুব জটিল অবস্থায় চলে যায়। তবে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে চা বাগানে গিয়ে রোগ নির্ণয়ের কাজ করছি, যার কারণে রোগ শনাক্তের হার বেড়েছে।

বাংলাদেশীয় চা সংসদ সিলেট অঞ্চলের সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ শিবলি বলেন, শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি কম হলেও চা বাগান মালিকরা তাদের থাকার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, রেশন ইত্যাদির মতো সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করেন, যা অর্থের দিক দিয়ে পরিমাপ করা হয় না। সব সুযোগ-সুবিধা হিসাব করলে তাদের মাসিক মজুরি ১২-১৫ হাজার টাকা হয়, যা অন্য শিল্পের চেয়ে বেশি। তিনি বলেন, চা ছাড়া সব কিছুর দাম বেড়েছে। অধিকাংশ বাগান মালিক লোকসানে রয়েছেন। অনেক বাগান মালিক শ্রমিকের মজুরি দিতে পারছেন না। এভাবে চলতে থাকলে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ ভালো হবে না।

এদিকে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৮ সালে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ২০২১ ও ২০২৪ সালে আরও দুটি নির্বাচন আয়োজনের কথা থাকলেও তা আর হয়নি। এর ফলে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে দায়িত্বে আছে একই কমিটি।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরি বলেন, তিন বছরের জন্য বানানো কমিটি এখন ছয় বছর ধরে দায়িত্বে আছে। নতুন করে নির্বাচন না হওয়ায় সংগঠনটির নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ছে। শ্রমিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা ইউনিয়নের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে হওয়া দ্বিপক্ষীয় চুক্তি দুর্বল হচ্ছে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তর একটি ট্রেড ইউনিয়ন। এখানে এক লাখ কর্মঠ শ্রমিকসহ প্রায় ১০ লাখ মানুষ সংগঠনটির আওতায় রয়েছে। এই সংগঠনে তিন বছর ধরে নির্বাচন হচ্ছে না। সরকারকে আমরা নির্বাচন করে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছি। তা ছাড়া অনেক বিষয় আছে সরকার করে দিচ্ছি, করছি। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। সেজন্যই শ্রমিকরা নির্বাচনের দাবিতে ফুঁসে উঠেছেন।

বিভাগীয় শ্রম দপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম বলেন, শ্রম আইনে চা শ্রমিকদের যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। তাদের দাবি-দাওয়া অমূলক নয়। আবার একেবারে যে বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তেমন না। অনেক চা বাগান তা বাস্তবায়ন করেছে। আমরা কাজ করছি শ্রমিক-মালিক দুই পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে। নির্বাচনের জন্য এরই মধ্যে চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দুই কিস্তিতে ২৫ লাখ টাকা পেয়েছি। মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে অবহিত করা আছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া রুটে বাস চলাচল শুরু

জামায়াতের আমিরের সঙ্গে ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ

স্মার্টফোনের জন্য বাবা-ছেলের আত্মহত্যা

কুষ্টিয়ায় জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা

শিক্ষক-কর্মচারীদের মারধরের মামলায় আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

ভাগ্যে কী আছে, জেনে নিন রাশিফলে

এবার পুরোপুরি বন্ধ হলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

রুশ তেলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বিপাকে ভারত-চীন

আনন্দ মোহন কলেজে সংঘর্ষের পর হল বন্ধ ঘোষণা

রাজশাহীর সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ

১০

বাবা হারালেন নির্মাতা রায়হান রাফী

১১

দাবানলে মৃত্যু বাড়ল, সতর্কতা আগামী সপ্তাহেও

১২

রাজধানীতে যেমন থাকবে আজকের আবহাওয়া

১৩

পঞ্চগড়ে কমছে শীতের তীব্রতা, তাপমাত্রা বেড়ে ১৩ ডিগ্রি

১৪

জবির সাজিদ একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে অনশন

১৫

বায়ুদূষণে শীর্ষে ঢাকা

১৬

পাগলা মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বরখাস্ত

১৭

সিলেটে তেলের পাইপলাইন থেকে তরল পদার্থ চুরি, গ্রেপ্তার ১

১৮

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৯

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

২০
X