বিপুল গৌরব আর সম্মানের সঙ্গে বিদেশে চিকিৎসা নিতে গেলেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। গতকাল মঙ্গলবার উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনের পথে রওনা হয়েছেন তিনি। রাত ১০টায় তিনবারের এই প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কাতারের আমিরের পাঠানো একটি অত্যাধুনিক এয়ার অ্যাম্বুলেন্স হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে। দেশ ছাড়ার আগে লাখো নেতাকর্মীর ভালোবাসায় সিক্ত হন খালেদা জিয়া।
গুরুতর অসুস্থ হলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিহিংসার কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারেননি ৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া। বারবার তার পরিবারের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। তার মুক্তির লক্ষ্যে বিএনপি সভা-সমাবেশ, মিছিল, গণঅনশন, দোয়া মাহফিল থেকে শুরু করে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, কালো পতাকা মিছিল, স্মারকলিপি প্রদান, কূটনীতিকদের কাছে আবেদনসহ বহুমুখী তৎপরতা চালালেও কোনো কিছুতে মন গলেনি হাসিনা সরকারের। এমনকি বিগত সরকারের তরফে তাচ্ছিল্য করে বলা হয়েছিল ‘তিনি (খালেদা জিয়া) সুস্থ আছেন’। দীর্ঘ এই সময়ে মাঝেমধ্যেই রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন খালেদা জিয়া। বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনে শরীরে বিশেষ অস্ত্রোপচারও করা হয়।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির সাজানো মামলায় আওয়ামী সরকারের ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ খালেদা জিয়াকে সাজা দিলে ওইদিনই তিনি কারাবন্দি হন। ২০২১ সালের নভেম্বরে খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন চিকিৎসকরা। তার পরিবার ও দলের পক্ষ থেকেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে বারবার আবেদন-নিবেদন জানানো হয়। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার প্রতিবারই তা উপেক্ষা করেছে। করোনা মহামারি শুরুর পর পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় ২০২০ সালের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে চিকিৎসার জন্য ছয় মাসের সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার। এরপর থেকে তার পরিবারের আবেদনে দণ্ডাদেশ স্থগিতের মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হয়। তিনি গুলশানের ভাড়া বাসায় অবস্থান করেন। চিকিৎসার জন্য তার পরিবারের সদস্যরা তাকে দেশের বাইরে নিতে চাইলেও সে অনুমতি মেলেনি। ২০২০ সালে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির পর থেকেই খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার দাবি জানায় তার পরিবার ও বিএনপি। সরকারের কাছে একাধিকবার লিখিত আবেদন করা হয়। কিন্তু সরকার অনুমতি দেয়নি। ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে আবারও সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার। তিনি বোনকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে লিখিত আবেদন দিয়েছিলেন। সে সময় খালেদা জিয়া রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওই আবেদনে খালেদা জিয়াকে আদালতের মাধ্যমে জামিন দিতে বা বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয় বলে সূত্র জানায়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসক দলের সদস্য ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন সে সময় বলেছিলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য এ পর্যন্ত পাঁচবার সরকারের কাছে অনুমতি চেয়েছে তার পরিবার। কিন্তু আবেদনের বিষয়ে সরকার সহযোগিতা করেনি। ২০২০ সালের আগস্টেও তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু ‘একজন দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির এই সুযোগ পাওয়ার অধিকার নেই’ উল্লেখ করে সরকার ওই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল। এর পরও খালেদা জিয়াকে বিদেশে গিয়ে উন্নত চিকিৎসার অনুমতির জন্য তার বড় বোন সেলিনা ইসলাম বিগত সরকারের কাছে বেশ কয়েকবার আবেদন করেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১৮ মার্চ পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করার আইনি সুযোগ আছে; কিন্তু বিদেশে যাওয়ার অনুমতি বা অন্যকিছু করার আইনি সুযোগ নেই। খালেদা জিয়া কিন্তু মুক্ত। তাকে দুটো শর্ত দেওয়া হয়েছে। একটা হচ্ছে তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না, দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে তিনি ঢাকায় থেকে চিকিৎসা নেবেন।’ তৎকালীন আইনমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘বহুবার আমি আইনের ব্যাখ্যা দিয়েছি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার বাইরে গিয়ে আমাদের কিছু করার নেই। সরকারপ্রধান মানে হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি যেহেতু এটা নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন, এখন এটা পরিবর্তন করার আইনি কোনো বিধান নেই।’
বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, কারাগারের ভেতরে অস্বাস্থ্যকর এবং স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের কারণে খালেদা জিয়ার শরীরে নানা অসুখ দানা বাঁধে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, খালেদা জিয়া একজন জনপ্রিয় নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার তার বিরুদ্ধে সাজা দিয়ে দীর্ঘদিন কারাবন্দি রেখেছিল। তাকে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন। কারাবন্দির পর খালেদা জিয়া বেশ কয়েকবার গুরুতর অসুস্থ হন, যা খুবই উদ্বেগের বিষয়। আমরা বারবার খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দিতে আহ্বান জানালেও তা কর্ণপাত করেনি শেখ হাসিনার সরকার। আল্লাহর রহমতে এখন রাজকীয় সম্মানে বিশেষ বিমানে উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য গেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। আমি দলীয় নেতাকর্মীসহ সবার কাছে দোয়া চাই, আল্লাহ যেন আমাদের নেত্রীকে সুস্থ করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আসার তৌফিক দেন।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন বলেন, খালেদা জিয়া ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের চরম প্রতিহিংসার শিকার। তাকে হত্যা এবং রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশে কোনোরকম চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া থেকে বঞ্চিত রেখেছিল স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকার। আল্লাহর রহমতে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে এবং খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন।