বহুল আলোচিত ৪৩তম বিসিএসে বাদ পড়া ২২৭ জনের বেশিরভাগের নামেই সরকারের দুটি গোয়েন্দা সংস্থা দুই ধরনের প্রতিবেদন দিয়েছে। একটি সংস্থা একজন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য ‘উপযুক্ত’ মনে করলেও আরেক সংস্থা তাকে ‘অনুপযুক্ত’ মনে করে আপত্তি জানিয়েছে। অর্থাৎ একজন প্রার্থীকে দুইভাবে উত্থাপন করেছে দুই গোয়েন্দা সংস্থা। এ কারণে কপাল পুড়েছে অনেক চাকরিপ্রার্থীর। নির্ভরযোগ্য সূত্রে কালবেলা এ তথ্য জানতে পেরেছে।
ওই সূত্র জানায়, বাদ পড়া ২২৭ প্রার্থীর মধ্যে ১৯৫ জনের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। অথচ এই ১৯৫ জনের বেশিরভাগের নামেই আপত্তি আসেনি আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে। আবার দ্বিতীয় গোয়েন্দা সংস্থাটির প্রতিবেদনে বিরূপ মন্তব্য এসেছে ৭৭ জনের নামে। অর্থাৎ ভেরিফিকেশন করতে গিয়ে অনেক প্রার্থীর বিষয়ে দুই গোয়েন্দা সংস্থা একমত হতে পারেনি। তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সংস্থাগুলোর এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই প্রার্থীদের নিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, আলোচিত ২২৭ প্রার্থীর নিয়োগ সাময়িকভাবে স্থগিত আছে। আরেকবার যাচাই-বাছাই শেষে তাদের অনেককেই নিয়োগ দেওয়া হবে। এজন্য আগামী বৃহস্পতিবার বিশেষ সভা ডাকা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস-উর রহমানের সভাপতিত্বে ওইদিন সকাল সাড়ে ১১টায় সভাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সভা থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে জনপ্রশাসন।
তথ্য যাচাই করতে গিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের মিল-অমিলের কারণে এবারই প্রথম একটি বিসিএসে সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রার্থীর বাদ পড়ার ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাদ পড়া প্রার্থীরাও। এ নিয়ে দেশব্যাপী হচ্ছে ব্যাপক সমালোচনা। এমনকি গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য যাচাই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত ‘দালিলিক প্রমাণ’ ছাড়া তথ্য যাচাই করার কারণে এমনটি হচ্ছে।
জনপ্রশাসন গবেষক ও বিশ্লেষক মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া কালবেলাকে বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো স্থানীয় লোকজন কিংবা জনপ্রতিনিধিদের মুখের কথা শুনে চাকরিপ্রার্থীদের নামে প্রতিবেদন দেয়। এমন পদ্ধতিতে ভেরিফিকেশন করা হলে সঠিক তথ্য আসে না। এতে প্রার্থীদের নামে বিরূপ মন্তব্য আসতে পারে। কারণ, এলাকায় তার সঙ্গে জনপ্রতিনিধি কিংবা স্থানীয় লোকজনের সম্পর্ক ভালো নাও থাকতে পারে। ভেরিফিকেশন হওয়া উচিত দালিলিক তথ্যপ্রমাণসহ। কোনো ধরনের দালিলিক প্রমাণ ছাড়া কারও মুখের কথায় রিপোর্ট দেওয়া হলে একজন প্রার্থীর নামে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য মিলবে। একজন প্রার্থীর বিষয়ে একেক সংস্থা একেক রিপোর্ট দেবে। সুতরাং দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করে রিপোর্ট দিতে হবে।
পুনর্বিবেচনার আবেদন ২২৭ প্রার্থীর: বাদ পড়া ২৬৭ প্রার্থীর মধ্যে ২২৭ জন পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেছেন। ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর আবেদন করেন। আর ৪০ জন স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন। তারা ৪৩তম বিসিএসের চাকরিতে যোগদান করবেন না বলে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে জানানো হয়েছে। সাময়িক স্থগিত হওয়া প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হবে কি না, তা আরও যাচাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এজন্য আগামী বৃহস্পতিবার সভা করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, যাদের নামে ফৌজদারি মামলা নেই এবং ছাত্রজীবনে রাজনীতি করতে গিয়ে কোনো পদপদবিতে ছিলেন না—এমন প্রার্থীরা নিয়োগ পাবেন। বাদ পড়া প্রার্থীদের বিষয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে আরেকটি ভেরিফিকেশন করবে সরকার। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই বাদ পড়াদের নিয়োগ হবে। তবে ডিসি-ইউএনওর প্রতিবেদনও যদি নেগেটিভ বা বিরূপ মন্তব্য আসে, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর নিয়োগ হবে না।
শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী কালবেলাকে বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে শুরু থেকেই ছিলাম। রাজনৈতিক কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। আমার পুলিশ ভেরিফিকেশন ঠিক ছিল। তবে মনে হয় এনএসআইর ভেরিফিকেশনে ত্রুটি ছিল। দ্বিতীয় দফায় যে ভেরিফিকেশন হয়েছে, সে সময় বেশ কয়েকজন কয়েকবার করে বাড়ি গিয়েছে। কিন্তু কোনো ত্রুটি না পেলেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন সাজানো হয়েছে।’
ছাত্রলীগের নেতারাও গেজেটে: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হল শাখার দুই নেতার একজন পুলিশ ও অন্যজন শিক্ষা ক্যাডার পেয়েছেন। শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক পদপ্রত্যাশী ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক এক সাংগঠনিক সম্পাদক। অন্যদিকে, পররাষ্ট্র ক্যাডারে চূড়ান্ত নিয়োগ পেয়েছেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক দুই নেতা। এ ছাড়া ছাত্রলীগের সাবেক অনেক নেতাই ক্যাডার হয়েছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে তারা আপাতত ‘চুপ’ রয়েছেন। এসব কারণে শুধু ছাত্রলীগ নেতাদের বেছে বেছে বাদ দেওয়া হয়েছে, এমনটি মানতে নারাজ ছাত্রলীগের বাদ পড়া নেতারাই।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, চূড়ান্ত গেজেট হওয়া প্রার্থীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। তারা একটি নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠনের নেতা। অভিযুক্ত এসব প্রার্থীর গেজেট বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
কোন ক্যাডারে কতজন বাদ: বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে ৩৩ জন, পুলিশ ক্যাডারে ১২ জন, নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারে ১৩ জন, শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারে ছয়জন, রেলওয়ে পরিবহন ক্যাডারে একজন, তথ্য ক্যাডারে ৯ জন, পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে তিনজন, খাদ্য ক্যাডারে দুজন, জনস্বাস্থ্য ক্যাডারে পাঁচজন, মৎস্য ক্যাডারে ১০ জন, পশু সম্পদ ক্যাডারে ২৫ জন এবং বিসিএস (স্বাস্থ্য) ডেন্টাল সার্জন ক্যাডারে ছয়জনের বাদ পড়ার তথ্য জানা গেছে।
গত ৩০ ডিসেম্বর ৪৩তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৫ অক্টোবরের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে বিভিন্ন ক্যাডারে বাদ পড়েন ১৬৮ প্রার্থী। চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের আগামী ১৫ জানুয়ারি চাকরিতে যোগ দিতে বলা হয়েছে। এর আগে গত ১৫ অক্টোবর ২ হাজার ৬৪ জনকে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেখানে বিভিন্ন ক্যাডারে বাদ পড়েছিলেন ৯৯ জন। সব মিলিয়ে ৪৩তম বিসিএস থেকে বাদ পড়েছেন মোট ২৬৭ জন। তাদের মধ্যে ৪০ প্রার্থী চাকরি করতে ইচ্ছুক নন বলে জানা গেছে। এজন্য তারা স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন।