রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব পণ্যের মধ্যে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে রান্নার গ্যাস, প্লাস্টিকের টিফিন বক্স, জুতাসহ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের নানা পণ্য রয়েছে। এতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিপাকে থাকা সাধারণ মানুষের খরচের পাল্লা আরও ভারী হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে দেদার কর ছাড় দিয়েছে এনবিআর। ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে বিভিন্ন পণ্যে কর ছাড় দেওয়া হলেও তাতে অবশ্য তেমন সুফল মেলেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং কিছু পণ্যের দাম আরও বাড়তে দেখা গেছে।
এনবিআর সূত্র বলছে, বিভিন্ন আমদানি পণ্যে কর ছাড় দিতে গিয়ে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাতে হয়েছে সরকারকে। আর সেই ঘাটতি মিটিয়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে এবার সাধারণ ভোক্তার ওপর ভর করছে এনবিআর। ৪৩ ধরনের পণ্যে ভ্যাটের হার বাড়ানোর পাশাপাশি বেশকিছু পণ্যে সম্পূরক শুল্কও বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়েও সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা চাপাচ্ছে এনবিআর। এতে বড় ধরনের বিপাকে পড়বে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের সাংসারিক খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে চিকিৎসা ব্যয়। পাশাপাশি বাড়বে বিদেশ ভ্রমণের খরচও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাজস্ব সুবিধা দেওয়ার কারণে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে এই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত তো রয়েছেই। কারণ, আইএমএফের ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল, কর ছাড় কমিয়ে দিয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো।
যেসব পণ্যে ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব:
এনবিআর সূত্র জানায়, মিষ্টির দোকানের ভ্যাটের হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ, রেস্টুরেন্টের খাবারে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে তিন গুণ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বিক্রিতে ভ্যাট ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে দিগুণের বেশি বাড়িয়ে ৫ শতাংশ, এলপি গ্যাসে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিমান টিকিটের ওপরও ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ রুটের বিমান টিকিটে ভ্যাট ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের বিমান টিকিটে ভ্যাট ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা, এশিয়ার দেশগুলোর বিমান টিকিটে ভ্যাট ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা এবং ইউরোপ-আমেরিকার টিকিটে ভ্যাট ৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কাপড়ের দোকানের ভ্যাটের হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ এবং প্রিন্টিং প্রেস থেকে শুরু করে মোটর কার ওয়ার্কশপ, ডকইয়ার্ড, রিপেয়ার অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স, নন-এসি হোটেল, টেইলারিং শপসহ প্রায় ১৫ ধরনের ব্যবসায় ভ্যাটের হার বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করেছে এনবিআর।
সূত্র আরও জানায়, স্থানীয় পর্যায়ে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রেও বাড়তি ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করেছে এনবিআর। এ ক্ষেত্রে ২৫ ধরনের পণ্য সরবরাহে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যার অধিকাংশ ভ্যাট হার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। এর মধ্যে রয়েছে লেমিনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্স, পেট্রোলিয়াম বিটুমিন, হার্ডরক, ট্রান্সফরমার, টিস্যুপেপার, চাটনি, আলু, তরল দুধ, টমেটো সস, ট্রান্সফর্ম অয়েল, নারিকেলের ছোলার তৈরি ম্যাট্রেস, সানগ্লাস, বিস্কুট, কয়েল জাতীয় পণ্য, রাবার প্রসেসিং অয়েলসহ বিভিন্ন পণ্য। এই ২৫ ধরনের পণ্যে ভ্যাট বাড়িয়ে ১৮ দশমিক ১৩ বিলিয়ন টাকা রাজস্ব বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি।
এ ছাড়া হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাবার দোকানসহ ১৫ ধরনের পণ্য সেবায় ভ্যাটের হার বাড়িয়ে ১৫ দশমিক ৫০ বিলিয়ন টাকা রাজস্ব বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। আর জুতা ও প্লাস্টিক টিফিন বক্স খাতে নতুন করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে ৬ বিলিয়ন টাকা রাজস্ব আদায়ের প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি।