‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করতে যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে সমুন্নত রাখতে এবং বিপ্লবের সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে আগামীকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই ঘোষণা দেওয়া হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই ঘোষণাপত্রকে ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’ আখ্যা দিয়ে এর সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে জানিয়েছে সরকার। অন্যদিকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’-এর মাধ্যমে সংবিধানকে কবর দেওয়ার কথায় ‘ব্যথা’ পেয়েছে বিএনপি। তবে ঘোষণাপত্র ঘিরে ‘থার্টিফার্স্ট ডিসেম্বর, নাউ অর নেভার’—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের অনেকের এমন নানা পোস্ট ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রে কী থাকছে কিংবা অভ্যুত্থানের এতদিন পরে কেন এই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হচ্ছে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা আগ্রহ তৈরি হয়েছে, বিরাজ করছে এক ধরনের উদ্দীপনা। বিভিন্ন মহলেও চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। তাই সবার দৃষ্টি এখন জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের দিকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের ফলে পতন হয় স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের। আওয়ামী সরকার পতনের আগে আন্দোলন চলাকালে তৎকালীন সরকারি বাহিনী ও আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর অস্ত্রের মুখে রাজপথে থাকতে হয়েছে বিপ্লবীদের। হারাতে হয়েছে প্রায় দেড় হাজার প্রাণ এবং আহত হতে হয়েছে ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষকে। যার কারণেই নতুন এক বাংলাদেশ পেয়েছে এ দেশের সর্বস্তরের জনতা। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনের কয়েক মাসে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরনের অসন্তোষ দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কর্মকর্তারাও একটি সংস্কার প্রস্তাব ঘিরে আন্দোলনে নেমেছেন। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় যখন রদবদলের চেষ্টা করা হয়েছে, তখনো এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এমন মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ও এর অন্য সহযোগী শক্তিগুলোও হাল ছাড়েনি। যে কোনো মূল্যে তারা অভ্যুত্থানকারীদের ভিত নড়বড়ে করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত বলে অনেকেই মনে করেন। বিএনপির অভিযোগ, দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীল করতে পতিত ফ্যাসিবাদ এবং তার দোসরদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এমন প্রেক্ষাপটে নতুন বাংলাদেশ প্রাপ্তির পেছনের বিশাল ত্যাগ-তিতিক্ষা, বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি আদায়ে আগামীর সংগ্রামে চব্বিশের বিপ্লবীদের টিকে থাকতে এবং চব্বিশের স্পিরিটকে একাত্তরের মতো শক্তভাবে দাঁড় করাতে একটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রয়োজন বোধ করছেন আন্দোলন সংশ্লিষ্টরা। তাই জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন কালবেলাকে বলেন, ফ্যাসিবাদী হাসিনার পতন নিশ্চিত করার জন্য এবং বাংলাদেশের নতুন দ্বার উন্মোচন করার জন্য যে যেভাবে পেরেছে আন্দোলনের সময় যার যার অবস্থান থেকে কাজ করেছে। এই আন্দোলনে ২ হাজারের মতো মানুষ শহীদ হয়েছেন, হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। এত বড় একটা ঘটনার এখন পর্যন্ত কোনো দালিলিক স্বীকৃতি নেই। এ স্বীকৃতির প্রয়োজন আমরা এই মুহূর্তে অনুভব করছি। এটা না হলে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি ‘গণঅভ্যুত্থান হয়নি’ বলে প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লাগবে।
তিনি আরও বলেন, একাত্তরের মতো আমাদের এই ঐতিহাসিক চব্বিশকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা যারা ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, আমাদের এই কাজকে স্বীকৃতি না হলে ফ্যাসিবাদী শক্তি এক সময় আমাদের হয়তো অন্যায়ভাবে দোষীর কাতারে দাঁড় করাবে। এজন্য আমরা এই বিপ্লবের সাংবিধানিক এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই।
ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুল হক সুপণ কালবেলাকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই উদ্যোগকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখছি। কারণ, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিটি সামাজিক আন্দোলনের পর এর ওপর ভিত্তি করে একটা ডকুমেন্ট প্রয়োজন হয়। যেমন ইংল্যান্ডের ম্যাগনাকার্টা, ফরাসি বিপ্লব ইত্যাদি। ঠিক সেইভাবে আমাদের দেশের ছাত্ররা আন্দোলন করে এত বড় একটা সফলতা নিয়ে এলো, সেটার কোনো দালিলিক প্রমাণ বা স্বীকৃতি থাকবে না, তা তো হতে পারে না। এটার অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা আছে।
৩১ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে এই বিপ্লবকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি চাওয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্তর্জাতিকভাবেও এর স্বীকৃতি আদায় করা হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সূত্রে জানা গেছে, জুলাই বিপ্লবের এই ঘোষণাপত্রে মোট ২৯টি ধারা থাকছে। শুরুর দিকের ধারাগুলো দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মূলকথা, ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার রূপ এবং শেষের ধারাগুলো দিয়ে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের কারণ, যুক্তি ও ঘটনাপ্রবাহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শেষের ধারাটিতে ১৪টি পয়েন্ট রয়েছে।
আরও জানা গেছে, ঘোষণাপত্রে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তি, ভারতবর্ষ ভাগ, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য, স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীনতা-পরবর্তী গণতান্ত্রিক অবক্ষয়, সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক স্বার্থের নেতিবাচক প্রভাব, ওয়ান-ইলেভেন বন্দোবস্ত কর্তৃক মুজিববাদী দৃষ্টান্তকে স্থায়ীকরণ, শেখ পরিবারের প্রশ্নাতীত ক্ষমতা এবং আধিপত্য দৃঢ়করণ, একাত্তরের চেতনাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বিগত সরকারের মুজিববাদ ও ফ্যাসিবাদকে জিইয়ে রাখা; সামরিক, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন এবং পুলিশসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকরণ; দুর্নীতি এবং দমনমূলক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার হাতিয়ারকরণ; ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিতকরণ ও বৈষম্য; রাজনৈতিক কারণে গুম, খুন, জেল-জুলুম, পিলখানা ষড়যন্ত্র, অর্থ পাচার, অত্যাচার, নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রসঙ্গে ঘোষণাপত্রে কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে—জানতে চাইলে সংগঠনের এক সমন্বয়ক বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার তাদের আমলে মানুষের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদ করলে শেখ হাসিনা কর্তৃক ‘রাজাকারের নাতি’ বলে অপমান করায় মানুষ সরকার পতনের দাবির দিকে ঝুঁকেছিল। এ সময় সরকারি বাহিনী ও আওয়ামী লীগ হাজার হাজার নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছে। ইন্টারনেট বন্ধ করে, কারফিউ জারি করে দেশের মানুষের প্রতি বর্বরতা চালিয়েছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ দল-মত নির্বিশেষে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এ মুহূর্তে আমরা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ’৭২ এবং ১/১১ এর বন্দোবস্তের ধারাকে পরিবর্তন করে নতুন এক বন্দোবস্তের দিকে যেতে চাচ্ছি।
আরেক সমন্বয়ক বলেন, ঘোষণা হতে যাওয়া জুলাই বিপ্লবের এই ঘোষণাপত্রটি আগস্টের ৫ তারিখ থেকে কার্যকর হবে। সরকারকে জাতীয়ভাবে এটির স্বীকৃতি দিতে হবে। আশা করি, আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি আসবে।
জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র সম্পর্কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম বলেন, আমরা যারা জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছি, তাদের জন্য এই ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, জুলাইয়ে আমরা খুনি হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। আমাদের আন্দোলনে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলে ‘পতিত স্বৈরাচার’ এই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। সুতরাং এই আন্দোলনকে সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতা দিতে প্রোক্লেমেশনের (ঘোষণাপত্র) দরকার, যাতে পতিত স্বৈরাচার চব্বিশ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ষড়যন্ত্র করার সুযোগ না পায়। এ ছাড়া রাজনৈতিক পালাবদলে চব্বিশকে অস্বীকার করে বিপ্লবীদের যাতে হয়রানি করতে না পারে, সেজন্যও জুলাই বিপ্লবের প্রোক্লেমেশন জরুরি।
এদিকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণার দিনকে সামনে রেখে বিভিন্ন স্লোগান লিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যরা। গত শনিবার রাত থেকে এই ক্যাম্পেইন শুরু করেন তারা। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লেখেন, ‘কমরেডস, নাও অর নেভার’। জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে লেখেন, ‘এ বছরই হবে। ৩১ ডিসেম্বর। ইনশাআল্লাহ!’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ লেখেন, ‘কমরেডস, ৩১ ডিসেম্বর! নাও অর নেভার!’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক রিফাত রশিদ তার ফেসবুকে লেখেন, ‘৩১ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন পর্যন্ত তাদের সবচেয়ে বড় বিপ্লবী স্টেপ নিতে যাচ্ছে।’
‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশকে সামনে রেখে গতকাল রোববার বাংলামটরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’-এর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে ‘নাৎসি বাহিনীর’ মতো অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করার কথা বলেছেন সংগঠনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। একই সঙ্গে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে ‘মুজিববাদী’ সংবিধান হিসেবে তুলে ধরে তার কবর রচনা করারও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির এক অনুষ্ঠানে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখভাগে থেকে অংশগ্রহণ করেছি। ১৯৭১ সালে আমার বহু বন্ধু শহীদ হয়েছে। শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে লেখা যে সংবিধান, সেই সংবিধানকে যখন কবর দেওয়ার কথা বলা হয়, তখন কিন্তু আমাদের কষ্ট লাগে।’
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা তোমাদের অগ্রজ হিসেবে কষ্ট পাই। কথাটা এভাবে বলা কি ঠিক হলো! ওই সংবিধানে যদি খারাপ কিছু থাকে, নিশ্চয়ই সেটা বাতিলযোগ্য।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্দেশে বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, ‘এ ধরনের কথা ফ্যাসিবাদের মুখ থেকে আসে। কবর দিয়ে ফেলব, মেরে ফেলব, কেটে ফেলব—এসব কথা ভালো কথা নয়। জাতি তাকিয়ে আছে আপনাদের দিকে। আমরাও তাকিয়ে আছি আপনাদের দিকে। আপনাদের মুখ থেকে এই ধরনের কথা আমরা আশা করি না।’