পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সংস্থাটির কার্যক্রম উন্নত ও সহজ করতে অটোমেশন প্রকল্প নিয়েছিল ২০১৮ সালে। প্রকল্প নেওয়ার পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রকল্পের অধীনে যেসব সেবা পাওয়ার কথা ছিল, তার কিছুই বর্তমানে পাচ্ছেন না বিএসইসির কর্মকর্তারা। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় একদিকে যেমন বিএসইসি প্রাপ্ত সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে, অন্যদিকে দেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি ও অনুদানের অর্থের অপব্যবহার হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে বিএসইসির অটোমেশন বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর সক্ষমতা বৃদ্ধি, কার্যক্ষমতা অধিকতর কার্যকর ও ক্রিয়াশীল করা, সরকারের নীতিনির্ধারণী ২৬টি শর্তের মধ্যে ১৭টি বিএসইসি সংশ্লিষ্ট পরিপালনে সহায়তা করতে এই প্রকল্প নেওয়া হয়। ‘ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-৩ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ নামে নেওয়া এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বিএসইসির কার্যক্রম আরও উন্নত ও সহজ হবে, যা পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এ প্রকল্পের মেয়াদকাল ছিল ২০২০ পর্যন্ত। প্রথম ধাপে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ১৭ কোটি ২১ লাখ এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে ব্যয় নেওয়া হয় ৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
এরপর ২০২০ সালের মে মাসে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। সে বছরের ১০ জুন প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ানোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় ৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা বাড়িয়ে ২৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা করা হয়। মেয়াদ বাড়ানো হয় আরও এক বছর।
২০১৮ সালে নেওয়া প্রকল্পের সময় বিএসইসির দায়িত্বে ছিলেন এম খায়রুল হোসেন। তখন এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে দুই বছর সময় ধরা হলেও তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর বিএসইসির দায়িত্বে আসেন শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তিনিও দায়িত্বে ছিলেন চার বছর। সর্বশেষ চলতি বছরে তার দায়িত্বের মেয়াদ আরও চার বছর বাড়ানো হয়। শিবলী রুবাইয়াত চার বছর দায়িত্বে থাকার সময়ও এ প্রকল্প সেভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। শিবলী রুবাইয়াত দায়িত্বে থাকার সময় কেন এ প্রকল্প চাহিদা অনুযায়ী বাস্তবায়ন হয়নি, বা এ প্রকল্পের আওতায় যেসব সেবা বিএসইসির পাবার কথা ছিল সেগুলো তারা কেন পাচ্ছেন না, এ নিয়ে কোনো আলোচনাও কেউ করতে পারেনি। এতে উন্নয়নের জন্য নেওয়া এ প্রকল্প রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অটোমেশনের মাধ্যমে যেসব সেবা দেওয়ার কথা ছিল: বিএসইসির নেওয়া প্রকল্পটিতে অটোমেশন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এই অংশকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমত, রেগুলেটরি ইনফরমেশন সিস্টেম বা আরআইএস। এই সেবার আওতায় ছিল রেগুলেটরি রিটার্ন সাবমিশন, অ্যাপ্লিকেশন, রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড লাইসেন্সিং, রিস্ক বেজড সুপারভিশন, কমপ্লায়েন্ট ট্র্যাকিং, বিজনেস ইন্টেলিজেন্স এবং কেইস ম্যানেজমেন্ট। দ্বিতীয়ত, এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং বা ইআরপি। এই সেবার আওতায় ছিল অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম, পে রোল অ্যান্ড এইচআর, ডিপার্টমেন্ট প্রিন্টার্স, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড স্টোর ম্যানেজমেন্ট, ডকুমেন্ট ম্যানেজমেন্ট, লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট, অ্যাক্সেস কন্ট্রোল এবং ভিজিটর ম্যানেজমেন্ট। তৃতীয়ত, ইনফরমেশন টেকনোলজি বা আইটি। এই সেবার আওতায় ছিল সার্ভার রুম আপগ্রেডস, সার্ভার ইনফ্রাস্ট্রাকচার, নেটওয়ার্ক আপগ্রেডস এবং ডিজাস্টার রিকভারি সাইট।
বিএসইসির এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, যে কোম্পানি এই কাজটি পেয়েছিল তারা প্রথমে এসে আমাদের কমিটির কাছে একবার বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। কমিটিও বুঝে নিয়েছে। কিন্তু এর কিছুদিন পরই আর সফটওয়্যার কাজ করে না। আমাদের ছুটিছাটা, স্টেশনারি, বেতনসহ সবকিছু ইআরপির মাধ্যমের হওয়ার কথা ছিল। ইআরপির মাধ্যমে আমাদের সব রিকুইজিশন হওয়ার কথা ছিল। আমাদের যে ইআরপি দেওয়া হয়েছে এখানে কোনো কাজ করতে পারি না। শুধু স্টেশনারির অল্প কিছু কাজ করা যায়। ছুটির আবেদন ইআরপিতে করলে সফটওয়্যার কাজ করে না। এমন আরও যেসব সেবা এই সফটওয়্যার দিয়ে পাবার কথা ছিল, সেগুলোর কিছুই পাই না।
তিনি বলেন, আমাদের বেতন কত, আমাদের প্রভিডেন্ট ফান্ডে কত জমা হয়েছে, আমরা কতদিন ছুটি কাটিয়েছি আর কতদিন পাওনা আছি, সবকিছুর বিস্তারিত একটা ডেটাবেজ থাকার কথা ছিল। এ ছাড়া ইস্যুয়ার কোম্পানি, ব্রোকার হাউজগুলো, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো থেকে শুরু করে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব কোম্পানি অনলাইনে তাদের ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু এটাও কাজ করে না।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা : এই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান কালবেলাকে বলেন, অটোমেশনের যে বিষয়টা ছিল তার প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান কনসালটেন্টরা তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই প্ল্যান অনুযায়ী আমরা পরবর্তী সময়ে ইআরপি এবং আরআইএস সফটওয়্যার আমাদের এখানে নিয়ে আসি। ইআরপি সফটওয়্যারটা বছর দেড়েক কাজ করার পর এটা আবার নতুন করে কাজ শুরু হচ্ছে। মাঝখানে ডেটা এন্ট্রি বন্ধ ছিল সেগুলো আবার শুরু হয়েছে। আর আরআইএসের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার সবই ইনস্টল হয়েছে। শুধু যখন ডেটা এন্ট্রি হবে, এই সময়টা একটু দেরি হয়েছে।
তিনি বলেন, তখন করোনা ছিল। এ জন্য প্রকিউরমেন্টও দেরি হয়েছে। যখন ডেটা এন্ট্রি শুরু হবে তখনই সফটওয়্যারের যে লাইসেন্স আছে, সেটার মেয়াদ চলে যায়। এটা আন্তর্জাতিক ভাইজর সফটওয়্যার। অনেক আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই সফটওয়্যারটা ব্যবহার করে। এটার নিয়মই হচ্ছে বছর শেষে বার্ষিক ফি দিয়ে তা আবার নবায়ন করতে হয়। এটার লাইসেন্স নবায়ন করা নেই বলেই তা আপাতত বন্ধ রয়েছে। নতুন করে নবায়ন করলেই আবার ডেটা এন্ট্রির কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া হার্ডওয়্যার সফটওয়্যার সবকিছু ঠিক আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিএসইসির পুঁজিবাজার টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য মো. আল আমিন কালবেলাকে বলেন, পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স অটোমেশন বা আইটির কাজগুলো বুয়েটের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তফা আকবর দেখছেন। ভবিষ্যতে যেন বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষাটা যেন নিশ্চিত হয়, এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে টাস্কফোর্স কমিটি।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। অটোমেশনের মধ্যে ইআরপি বাস্তবায়ন হয়েছে এবং কমিশন কিছু দিন ব্যবহারও করেছে। এখন কিছু ডেটা এন্ট্রি দিয়ে এগুলো আপডেট করতে হবে। আর আরআইএস সফটওয়্যার ডেটা এন্ট্রি করার পর এটা বাস্তবায়ন হবে, এটা এখনো শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। এগুলো বাস্তবায়ন করার এখনো সুযোগ আছে। এসব নিয়ে কমিশন কাজ করছে। আমরা আশাবাদী, আরআইএস দ্রুতই অপারেশনে আসবে।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ কালবেলাকে বলেন, এই প্রকল্পের অধীনে বিএসইসিসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সবার যে সেবা পাওয়ার কথা, তা কেন বাস্তবায়ন হলো না খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি করতে হবে।