উচ্চ আদালতের রায়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসায় জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশে ১৩-১৪ বছর ধরে চলমান সংকট কেটে গেছে বলে মনে করে বিএনপি। দলটির দাবি, এই রায়ের মাধ্যমে নতুন করে বিএনপির রাজনীতির যথার্থতাও প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, জনগণের দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে বিএনপিই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। তাদের অভিযোগ, ভোটবিহীন দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকতে পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার ক্ষমতার জোরে আদালতকে ব্যবহার করে এই ব্যবস্থা বাতিল করেছিল। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় দেশে নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়, যা প্রায় দেড় দশক ধরে অব্যাহত রয়েছে। বিএনপির দাবি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নির্বাচনকেন্দ্রিক ও রাজনৈতিক দীর্ঘমেয়াদি যে জটিলতাগুলো ছিল, আস্তে আস্তে সেগুলোর জট খুলতে শুরু করেছে।
দলটির নেতাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে নজিরবিহীন কারচুপির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। ফলে গণতন্ত্র মুখথুবড়ে পড়ে, একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে। এর মধ্য দিয়ে জাতির কাঁধে ফ্যাসিবাদ জেঁকে বসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরায় এখন নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। কারণ, দলীয় সরকারের অধীনে কখনো অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়, এটা প্রমাণিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে দেশে যে কয়টি নির্বাচন হয়েছিল, সেগুলো তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য ছিল বলে অভিমত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও।
বিএনপি মনে করে, এখন কী কী সংস্কার আনলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য হবে, অন্তর্বর্তী সরকার সে ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ নেবে। দলটির প্রত্যাশা, রাজনৈতিক মতৈক্যের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফরম্যাটেরও সমাধান হবে। আর সরকার চাইলে এ ব্যাপারে বিএনপি তাদের মতামত দেবে। সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে বিএনপি তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে। এর অংশ হিসেবে দলটি ইতোমধ্যে সরকার গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করাসহ দলীয় ৬২ দফা সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন জনগণের দাবি ছিল। বিএনপি এটাতে বিশ্বাস করে। এজন্য বিএনপি আন্দোলন করেছে। খালেদা জিয়া এ দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, যেন জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের ইচ্ছামতো ভোট দিতে পারে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সফল সিস্টেম, এটা প্রমাণিত। একানব্বইতে জনগণ ভোট দিয়ে বিএনপিকে সরকারে বসায়। ছিয়ানব্বইতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। আবার ২০০১-এ এই দেশের জনগণই ভোট দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে দেশের মানুষ ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে পারে, এটার প্রমাণ এ দেশে রয়েছে। কিন্তু স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার গণতন্ত্রকে হত্যা করে গায়ের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিল।
তিনি বলেন, বিজ্ঞ উচ্চ আদালত আজকে (মঙ্গলবার) পঞ্চদশ সংশোধনী যে বাতিল করেছেন, সেটি একটি অত্যন্ত ন্যায্য বিষয়। কারণ, একটি রাজনৈতিক দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোকে একটি দেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত করা, একটি দলের নেতার বক্তব্যকে সংবিধানে সন্নিবেশিত করা সম্পূর্ণ সংবিধানবিরোধী ছিল। উচ্চ আদালত এই রায় দিয়ে জনগণের সেই দাবিকে বাস্তবায়ন করেছেন। জনগণের পক্ষে রায় দেওয়ার জন্য আমরা উচ্চ আদালতকে অভিনন্দন জানাই। এই রায় দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে এবং একটি সুন্দর বাংলাদেশ গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা।
এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোন ফরম্যাটে গঠিত হবে, সে বিষয়ে বিএনপির কোনো ভাবনা আছে কি না—জানতে চাইলে ড. মোশাররফ বলেন, আমরা এই দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করেছি। আমাদের ধারণা আগেও আছে, এখনো আছে। অন্তর্বর্তী সরকার এ ব্যাপারে কোনো পরামর্শ চাইলে বিএনপি অবশ্যই দেবে।
খালেদা জিয়া সরকারের সময় ১৯৯৬ সালে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। এরপর এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালের ১০ মে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। এর মাস দেড়েক পরই ৩০ জুন সংসদে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এরপর থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহালের দাবিতে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। তখন এটি ছিল বিএনপির একদফা দাবি। দাবি পূরণ না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল দলটি। কিন্তু ক্ষমতার কোনো হেরফের হয়নি। আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে। এর পরও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অটল থাকে বিএনপি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দলীয় অবস্থান পরিবর্তন করে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল বিএনপি। কিন্তু সে নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি ঘটে। নির্বাচনের পরপরই তারা বলেছিল, দলীয় সরকারের অধীনে যে কখনো অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং সরকারের পদত্যাগ দাবিতে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলনে নামে বিএনপি, যেখানে ৪০টির মতো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। কিন্তু দীর্ঘ এক বছরের আন্দোলনেও দাবি পূরণ না হওয়ায় ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও বয়কট করে তারা। তবে ওই নির্বাচনের সাত মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় ঘটে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর পঞ্চদশ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ১৯ আগস্ট রুল দেন। রুলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এই রুলে ইন্টারভেনার (আদালতকে সহায়তা করতে) হিসেবে অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপিও পক্ষভুক্ত হয়। শুনানিতে বিএনপির আইনজীবীরা দলের যুক্তিগুলো তুলে ধরে। গতকাল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ধারা দুটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে, যেটি হচ্ছে গণতন্ত্র।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়ার এই রায় ঘোষিত হওয়ার পর এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি গঠিত নির্বাচন সংস্কারবিষয়ক কমিটির আহ্বায়ক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, এটাই সত্যি যে, আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে বিএনপিই জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সংসদে প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ‘কেয়ারটেকার’ প্রথা প্রবর্তন করেছিল। এ ক্ষেত্রে যা অনুধাবন করতে হবে সেটা হলো, বাংলাদেশের মানুষের সাইকোলজিক্যাল প্যারাডাইম। তারা তাদের নেতৃত্বকে অত্যন্ত ভালোবাসে—এটা যেমন ঠিক, তেমনি আবার তারা একই সঙ্গে ‘অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট’। কাজেই রাজনৈতিক দলের চেয়ে এ দেশের মানুষ রাজনীতিটার ওপরে বেশি আস্থা রাখে। আর এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি জনগণের রাজনীতি করে বলেই কিন্তু জনতার রায় মেনে নিয়েছিল। আজ (মঙ্গলবার) সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে নতুন করে বিএনপির রাজনীতির যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি।