ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও দ্রুততম সময়ে নির্বাচন চায় বিএনপি। দলটি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু একটি অনির্বাচিত সরকার, নির্বাচন প্রলম্বিত হলে এখন দেশবিরোধী নানা ধরনের যে প্রোপাগান্ডা-ষড়যন্ত্র চলছে, সেটি আরও ডালপালা মেলতে পারে। তাই আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে ধারণা নয়, এ ব্যাপারে রোডম্যাপ আকারে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা চায় দলটি।
বিএনপি আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ নির্বাচন চায়। বিভিন্ন সময় দলটির অভ্যন্তরীণ আলোচনায় সেটি উঠে আসে। তবে আগামী বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন হলেও সেটির বিরোধিতা করবে না দলটি। এটিকে সহনীয় বিবেচনা করে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে এই সময়টুকু দিতে চায় তারা। এটাকে যৌক্তিক সময় বলে মেনে নেবে বিএনপি।
বিএনপি মনে করে, আগামী বছরের প্রথমার্ধের ভেতরে প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষে পরবর্তী তিন-চার মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। সেক্ষেত্রে ২০২৫ সাল অতিক্রম হওয়ার কথা নয়। তবে নির্বাচন ২০২৬ সালে গেলে সেটি হবে দীর্ঘ সময়। এর মধ্য দিয়ে সময়ক্ষেপণ হবে, যেটি কাম্য নয়। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে ভোটাধিকার বঞ্চিত মানুষ এখন ভোট দিতে উন্মুখ। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো না হলেও দলটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে তাদের এমন মনোভাব জানা গেছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারে মনোযোগ দেয় সরকার। এ লক্ষ্যে ১৫টি কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে চললেও সরকারের তরফ থেকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানানো হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে দুই মাস ধরে নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপি। সাম্প্রতিক সময়ে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর গ্রেপ্তারসহ কয়েকটি ঘটনাকে ঘিরে দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীল করতে দেশি-বিদেশি নানান চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র শুরু হয় বলে অভিযোগ দলটির। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, আলোচনা সভা থেকে রোডম্যাপের দাবি আরও জোরালো করেন বিএনপি নেতারা।
দলটির নেতাদের অভিমত, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিএনপি তাদের ৩১ দফায়ও সংস্কারের কথা বলেছে। তাই নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা উচিত। এর অংশ হিসেবে দ্রুত রোডম্যাপ দিলে দেশ পুরোপুরি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ঢুকে যাবে। এতে করে বিদ্যমান অস্থিরতাও কেটে যাবে। তা ছাড়া ১৫-১৬ বছর ধরে ভোটাধিকার বঞ্চিত জনগণও এখন ভোট দিতে উন্মুখ। আর সব সংস্কার শেষে নির্বাচন করতে গেলে সেটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। নির্বাচিত সরকার এসে তারা সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নেবে।
এমন অবস্থায় সংস্কার ও রোডম্যাপ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল দু-একজন উপদেষ্টাও বক্তব্য দেন। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রয়োজনীয় সব সংস্কার শেষে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। অন্যদিকে নির্বাচিত সরকারের অধীনে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি তোলায় রাজনৈতিক দলগুলোর অতীতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘আজকে তারা বলছে, সংস্কার তারাই সবচেয়ে ভালো করতে পারবে, এটাই তো গণতান্ত্রিক দেশের কথা। তা হলে তারা ৫৩ বছর কেন করেননি?’ এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত রোববার বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার কী করতে চাইছে, রাষ্ট্র মেরামতের জন্য তাদের আর কত মাস কিংবা কত সময় প্রয়োজন, সেটি জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনার রোডম্যাপ ঘোষণার কথা শুনলেই যদি উপদেষ্টাদের চেহারায় অস্বস্তির ছাপ ফুটে ওঠে, সেটি হবে অবশ্যই গণআকাঙ্ক্ষাবিরোধী।’
বিএনপি নেতা ও উপদেষ্টাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়। এর মধ্যে বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে একটা ধারণা দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমি সব প্রধান সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদের যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।’
বিএনপি নেতাদের অভিমত, দেশে একদিকে নানামুখী চক্রান্ত, অন্যদিকে নির্বাচন প্রলম্বিত করার মতো নানান যে সমীকরণ, সেটি ফুটে উঠছিল। এমন প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণে সুনির্দিষ্টভাবে রোডম্যাপের ঘোষণা না থাকলেও সরকার যে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের চিন্তা করছে, সেটাকে সাধুবাদ জানিয়েছে দলটি। এ ক্ষেত্রে বিএনপি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে না পারলেও নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে ধারণায় নেতাদের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি লক্ষ করা গেছে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন ঘিরে যে এক ধরনের ধোঁয়াশা ছিল, তা কাটতে শুরু করবে বলে মনে করেন দলটির অনেকে। তারা এ-ও মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রস্তুতিও নেওয়া শুরু করবে। তবে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা হলে সেটা পুরোদমে শুরু হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছেন। কিন্তু তাতে সুস্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ নেই। তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনীয় কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার করা হবে, সে জন্য কতটা সময় প্রয়োজন, তা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে স্পষ্ট নয়। আমরা আশা করি, তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) সংস্কারের সময় ও নির্বাচনের সময় সুনির্দিষ্ট করে একটি রোডম্যাপ দেবেন।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া: ড. ইউনূস আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে যে ধারণা দিয়েছেন, সেটাকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক সমমনা দলগুলোও। নেতাদের প্রত্যাশা, প্রধান উপদেষ্টা সামনে আরও নির্দিষ্টভাবে একটি পরিকল্পনা জাতির সামনে তুলে ধরবেন। গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আগামী নির্বাচনের দিনক্ষণের ব্যাপারে আগে তো কোনো ধারণা ছিল না। প্রধান উপদেষ্টা এখন সে ধারণা দিলেন। সেদিক থেকে এটা ভালো। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট না হলেও নির্বাচনের একটা টাইমফ্রেম তার (ড. ইউনূস) বলা হয়ে গেছে। খুব বেশি দেরি হলে, তিনি ২০২৬ সালের প্রথমার্ধ বলেছেন। একটি স্বচ্ছ-সঠিক ভোটার লিস্ট করতেই তো নয় মাস লাগবে। সুতরাং এটাকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখছি।
এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আমরা মনে করি, দেড় থেকে দুই বছরের মাথায় সংস্কার শেষ করে একটি নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। আমরা আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বলবেন। তারপরও যেটা বলেছেন, আমরা মনে করি, তিনি সামনে আরও সুন্দরভাবে, আরও নির্দিষ্টভাবে একটি পরিকল্পনা আমাদের সামনে তুলে ধরবেন। আমরা চাই, এই সরকার সফল হোক। তারা সুশাসনের মধ্য দিয়ে সংস্কার এবং নির্বাচন এগিয়ে নিয়ে এই জাতির যে আশা-প্রত্যাশা, সেটি পূরণ করবেন।
১২ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন মো. ফারুক রহমান বলেন, দেশে এখন নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় দ্রুত একটি নির্বাচিত সরকার দরকার। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ভোটাধিকারবঞ্চিত মানুষও এখন ভোট দিতে উন্মুখ। তাই আমরা আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বলবেন—কখন, কী করবেন, তার একটা পথনকশা দেবেন। ফারুক রহমান বলেন, যত দ্রুত নির্বাচন হবে, ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল হবে।