ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সময় জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারের নামে থাকা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে গেছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক জিয়া পরিবারের নাম বদল শুরু করে। এরপরই বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের নামে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের নামকরণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর ২০১০ সালে জিয়াউর রহমানের নামে থাকা ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করা হয়। এরপর একে একে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদ ভবনের বিপরীতে ‘জিয়া উদ্যান’-এর নাম বদলে রাখা হয় ‘চন্দ্রিমা উদ্যান’। আওয়ামী লীগের প্রতিহিংসা থেকে রেহাই পাননি মওলানা ভাসানীও। ঢাকার বিজয় সরণিতে মওলানা ভাসানী নভো থিয়েটারের নাম বদলে রাখা হয় বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার! এভাবে ঢাকাসহ সারা দেশের অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে নামকরণ করা হয় বঙ্গবন্ধুর নামে।
এমনকি শেরেবাংলা নগর থেকে জিয়াউর রহমানের সমাধিসৌধ সরিয়ে ফেলতে উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। শেখ হাসিনার টানা দেড় দশকের বেশি শাসনামলে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন খ্যাতিমান ব্যক্তির নামে থাকা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় জিয়াউর রহমানের ম্যুরালও ভেঙে ফেলা হয়। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের দাবি, জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারের নাম নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। কিন্তু নাম মোছা যায়নি। তাদের নাম তবু রয়ে গেছে মানুষের হৃদয়ে।
শেখ হাসিনার গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার নামে থাকা ঠিক কতগুলো স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই বিএনপির কাছে। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু প্রতিষ্ঠানের তালিকা সংগ্রহ করেছে দলটির কেন্দ্রীয় দপ্তর। এ তালিকায় ১৭টি স্থাপনার নাম পরিবর্তন বা নামফলক ভেঙে ফেলার তথ্য জানা যায়।
প্রতিষ্ঠান থেকে জিয়া পরিবারের নাম মুছে ফেলার বিষয়ে বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালবেলাকে বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার বিগত প্রায় ১৬ বছর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং জিয়া পরিবারের নাম মুছে ফেলার নানা রকম ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু শতচেষ্টা করেও জনগণের হৃদয় থেকে শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলতে পারেনি, কখনো পারবেও না। জিয়াউর রহমান গণমানুষের নেতা, দেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক। গণমানুষের কল্যাণে তার রাজনীতি ও কর্মসূচির জন্য তিনি গণমানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন। তার নাম যারাই মুছে ফেলার চেষ্টা করবে, তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন কালবেলাকে বলেন, স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের নামটি মুছে দিতে আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন মাধ্যমে এমন কিছু নেই, যা করেনি। বর্তমানে তারাই পলাতক। তিনি বলেন, মতের অমিল থাকলেও রাজনৈতিকভাবে গুণীজনকে হেলা করা উচিত নয়। আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলব, বিগত সরকার সারা দেশে জিয়া পরিবারের নামে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে নিজেদের খেয়াল খুশিমতো রেখেছে, সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সম্প্রতি বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের নামে সারা দেশে ২২০টি উপজেলায় স্টেডিয়াম নির্মিত হবে, তার কয়েক দিন পরই গত ১৪ নভেম্বর টাঙ্গাইল জেলা সদর স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় শহীদ মারুফ স্টেডিয়াম। আর জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণের মাঠের নামকরণ করা হয় ফারহান ফাইয়াজের নামে। দুজনই জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন। একই সঙ্গে কুষ্টিয়া জেলা সদর স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় শহীদ আবরার ফাহাদ স্টেডিয়াম। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ।
এর কয়েকদিন পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের নামে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নামকরণ করা হবে। সম্প্রতি যমুনা সেতুর নামকরণ পরিবর্তন করে ‘শহীদ আবু সাঈদ সেতু’ নামকরণের প্রস্তাব দিয়েছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
তবে আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশন এলাকায় সড়ক, ভবন ও স্থাপনার নামকরণ এবং পরিবর্তন সংক্রান্ত কাজ করে থাকে করপোরেশনের নগর পরিকল্পনা বিভাগ। নামকরণ ও পরিবর্তন সংক্রান্ত এ কাজের জন্য ২০১৪ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে প্রণয়ন করা হয় ‘সিটি করপোরেশনের সড়ক, ভবন ও স্থাপনা নামকরণ নীতিমালা-২০১৪’।
এদিকে সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণের বিষয়ে আইনি কাঠামো ঠিক করতে একটি উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। মূলত গত ২২ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণের বিষয়ে একটি নীতিমালা করা হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত বছরগুলোয় বিভিন্ন স্থাপনার নাম রাখা ও পরিবর্তন করা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা আছে। যে কারণে ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রায় সব জায়গা থেকেই শেখ পরিবারের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এভাবে এখন যদি জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের নামেও স্টেডিয়ামসহ অন্যান্য স্থাপনার নামকরণ শুরু হয় এবং আগামীতে নির্বাচিত সরকার একই ধারা (নাম পরিবর্তন) অব্যাহত রাখে, তাহলে দেখা যাবে ভবিষ্যতে অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এসে আবার সেই নামগুলো বদলে দেবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে এখনো অনুপস্থিত। নতুন বাংলাদেশে অন্তত প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণের ক্ষেত্রে একটা রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং স্থাপনার নামকরণের ক্ষেত্রে একটি আধুনিক নীতিমালা প্রণয়ন করার পরামর্শ দেন তারা।
যত প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম বদল খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর টানা তৃতীয় মেয়াদে অর্থাৎ সাড়ে ১৫ বছরের অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করেছে শেখ হাসিনার সরকার। তার মধ্যে ২০১০ সালে ঢাকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করা হয়। এ ছাড়া দেশের যেসব স্থাপনার নাম চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পরিবর্তন করা হয়েছিল, সেগুলো আগের নামে ফিরিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। যেমন বরিশাল জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বদলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে সময় বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানিয়ে একাধিক কর্মসূচি পালন করেছিল। এমনকি বিএনপি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে জাতীয় সংসদ অধিবেশন থেকে ওয়াক আউটও করে।
তথ্যমতে, ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার ঢাকার তেজগাঁও থেকে কয়েক কিলোমিটার উত্তরে কুর্মিটোলায় উড়োজাহাজ নামার জন্য একটি রানওয়ে তৈরি করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের পর তেজগাঁও বিমানবন্দরটি পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বিমানবন্দর হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সরকার কুর্মিটোলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করে এবং ফরাসি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের জন্য একটি রেল স্টেশন (বর্তমান এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশন) নির্মিত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিমানবন্দরটি অর্ধেক সম্পন্ন অবস্থায় ছিল এবং যুদ্ধের সময় বিমানবন্দরে গুরুতর ক্ষতি হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার এটিকে দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। মূল রানওয়ে এবং কেন্দ্রীয় অংশটি খোলার মাধ্যমে ১৯৮০ সালে এয়ারপোর্টটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিমানবন্দরটির শুভ উদ্বোধন করেন। রাজনৈতিক কারণে আরও তিন বছর লাগে এটি সম্পন্ন হতে। অবশেষে ১৯৮৩ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ হিসেবে বিমানবন্দরের উদ্বোধন করেন। তবে ২০১০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি দরবেশ হযরত শাহজালালের (রহ.) নামে বিমানবন্দরটির নাম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামকরণ করে। এখানে হযরত শাহজালালকে সম্মানিত করা নয়, বরং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামটি বাদ দেওয়াই যে মূল উদ্দেশ্য ছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠিত অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন ও ছবি অপসারণ করে ফেলে। তথ্যমতে, ঢাকা মহানগরীতে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন ছাড়াও শেরেবাংলা নগরে ‘জিয়া উদ্যান’-এর নাম পরিবর্তন করে চন্দ্রিমা উদ্যান করা হয়।
এদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে শিশুদের আনন্দ-বিনোদনের লক্ষ্যে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে ‘শহীদ জিয়া শিশু পার্ক স্থাপিত হয়। সরকারিভাবে দেশের প্রথম এই শিশু পার্ক ১৯৮৩ সাল থেকে শিশুদের বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তখন এর নামকরণ হয় ‘শহীদ জিয়া শিশু পার্ক’। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে ১৫ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এ পার্ক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ঢাকা সিটি করপোরেশন। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো শনাক্ত করার উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ২১ মার্চ তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ঘোষণা দিয়েছিলেন শিশু পার্ক থেকে জিয়াউর রহমানের নাম সরিয়ে ফেলা হবে। এরপরই ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে পার্কের সামনে উন্নয়ন কাজের একটি বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে এটি বন্ধ ঘোষণা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
চলতি বছরের গত ৩ এপ্রিল রাতে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় অবস্থিত শহীদ জিয়া হল মিলনায়তনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ম্যুরালটি ভেঙে ফেলা হয়। এ জন্য নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানকে দুষছেন বিএনপির নেতারা।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৮ সালে নারায়ণগঞ্জ সফরকালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চাষাঢ়ায় ‘টাউন হল’ নামে ওই মিলনায়তনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তার মৃত্যুর পর ১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এমএ সাত্তার টাউন হল উদ্বোধনের সময় হলটির নাম রাখেন শহীদ জিয়া হল। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর মিলনায়তনটির নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তন’ রাখা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আবারও নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ জিয়া হল’ করা হয়। পরে ভবনটির উপরের অংশে জিয়াউর রহমানের একটি ম্যুরাল স্থাপন করা হয়। একপর্যায়ে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক সম্পূরক প্রশ্নে শামীম ওসমান জিয়া হলের জায়গায় নতুন ভবন নির্মাণ করে সেটিকে ‘ছয় দফা ভবন’ করার দাবি জানান। এরপরই জিয়ার ম্যুরালটি ভেঙে ফেলা হয়।
এদিকে ২০১৯ সালের এপ্রিলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক স্মারকে শহীদ জিয়াউর রহমান গার্লস হাই স্কুলের নাম সুখানপুকুর বন্দর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় এবং গাবতলী শহীদ জিয়া হাই স্কুলের নাম গাবতলী পূর্বপাড়া হাই স্কুল উল্লেখ করা হয়। নাম পরিবর্তনের বৈধতা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটির পক্ষে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পৃথক দুটি রিট করেন। ওদিকে ২০০৬ সালের ১৬ মার্চ জিয়া অডিটরিয়াম হল উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৬ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের জিয়া অডিটোরিয়ামের নাম পরিবর্তন করা হয়। কোনো প্রজ্ঞাপন বা নোটিশ ছাড়াই নামকরণ করা হয় কলেজ অডিটোরিয়ামের। গত ৮ ডিসেম্বর অডিটোরিয়ামের নাম রং করে আগের নামে জিয়া অডিটোরিয়াম লেখা হয়েছে। অভিযোগ আছে, তৎকালীন অধ্যক্ষ আব্দুর রশিদ জিয়া অডিটোরিয়ামের নাম পরিবর্তন করেছিলেন।
এ ছাড়া চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তরে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নাম থাকায় নামফলক ভেঙে ফেলে ছাত্রলীগ। গাজীপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ম্যুরাল এবং ছবি ভেঙে ফেলা হয়। বরিশাল মেডিকেল কলেজের ম্যুরাল ভেঙে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল স্থাপন করা হয়। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলায় সোনালী বস্ত্রালয়ের মোড়ে জিয়াউর রহমানের ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয়। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় বেগম খালেদা জিয়া মহিলা কলেজের নাম পরিবর্তন করে ফুলগাজী মহিলা কলেজ নামকরণ করা হয়। খাগড়াছড়ি শহরে জিয়াউর রহমানের ম্যুরাল ভেঙে ফেলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। নাটোরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলেজের অডিটোরিয়াম এবং জেলার পার্কে জিয়াউর রহমানের নামফলক ও ছবি ভেঙে ফেলা হয়। জয়পুরহাট সদর উপজেলায় শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজের নাম পরিবর্তন করে জয়পুরহাট ডিগ্রি কলেজ করা হয়। বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় একটি ব্রিজের নামফলকও ভেঙে ফেলা হয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য বদরুল আলম চৌধুরী শিপলু বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারের জনপ্রিয়তাকে ভয় পায়। সেজন্যই তার নাম মুছে ফেলতে বারবার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আল্লাহর হুকুমে দেশের জনগণ তা রুখে দিয়েছে এবং শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতন হয়েছে। জিয়া পরিবারের নাম দেশের জনগণের হৃদয়ে গেঁথে আছে। এটি কখনো মুছে ফেলা যাবে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান বলেন, বাংলাদেশে ব্যক্তির নামে স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নামকরণ একটি বহুল প্রচলিত ও বিতর্কিত বিষয়। এটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়া সাধারণত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সম্মান জানাতে করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেখা গেছে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নামকরণ করা হয়েছে মূলত শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে। প্রায় প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্নার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব গড়ে তোলার পেছনে আসল উদ্দেশ্যই ছিল নিজেদের নামের প্রচার, যা দেশের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অবদান বা স্মৃতি তুলে ধরতেই তাদের নামে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই নামকরণের বিষয়টি মূলত একটি পরিবারের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়ে। জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যে দল ও মতেরই অনুসারী হোন না কেন, তার নামে স্থাপনার নামকরণের ক্ষেত্রে ওই এলাকার মানুষের মতামত নেওয়া উচিত। যাতে নামকরণের বিষয়টি দলনিরপেক্ষ থাকে এবং দেশ-জাতি গঠনের অবদান রাখা ব্যক্তিকে তুলে ধরা যায়। এ জন্য একটি আধুনিক নীতিমালাও প্রণয়ন করা যেতে পারে।