কূটনৈতিক সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি ও চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই আজ সোমবার ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের দুই পররাষ্ট্র সচিব বৈঠকে বসছেন। সকাল ১০টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি নিজ নিজ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। পরে যমুনায় বিকেল সাড়ে ৪টায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করবেন বিক্রম মিশ্রি। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুদেশের মধ্যে এটিই উচ্চ পর্যায়ের প্রথম বৈঠক।
এর আগে গত বছরের নভেম্বরে দিল্লিতে সর্বশেষ পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়। প্রতিবছর ভারতের সঙ্গে ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) হলেও এবারের বৈঠককে গুরুত্বপূর্ণভাবেই দেখছে দুই দেশ।
কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আজকের এই বৈঠক এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে বড় ধরনের ফাটল ধরেছে। আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা দিল্লিতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। আর সম্মিলিত সনাতন জাগরণী মঞ্চের মুখপাত্র ও সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার যেন সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। তাই দুই পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আলোচনায় সাম্প্রতিক নানা ইস্যু উঠে আসার পাশাপাশি তা সমাধানের পথ নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে এরই মধ্যে নিশ্চিত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র। তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোর ঘটনাপ্রবাহ দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে, তাতে এই বৈঠকে কী আলোচনা হয় এবং এখান থেকে নতুন কোনো দিকে পরিস্থিতি মোড় নেয় কি না, তা নিয়ে আগ্রহ আছে মানুষের।
সফরে দুদেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো পর্যালোচনার পাশাপাশি, রাজনৈতিক বোঝাপড়া, ভারতীয় গণমাধ্যমের বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার, ভারতে বসে শেখ হাসিনার বক্তব্য, ভিসার জট খোলা, সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, ভারত থেকে নিত্যপণ্য আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে রপ্তানির নানা বাধা সরানোসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনা হতে পারে। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠক থেকে বড় কিছু অর্জনের সুযোগ না থাকলেও, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুই দেশ বৈঠক বা আলোচনায় বসেছে—এটাই হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
জানা যায়, পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের এ বৈঠকে আলোচনার জন্য প্রাথমিক এজেন্ডা ঠিক করে থাকে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলো। আবার আলোচনার সময় অনেক ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিষয়ও উঠে আসে। তবে ঠিক কী নিয়ে আলোচনা হবে, সে সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত এজেন্ডা প্রকাশ করেনি কোনো পক্ষই। কর্মকর্তারা যে ধারণা দিচ্ছেন তা হলো, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের যে কোনো বৈঠকে কয়েকটি বিষয়টি নিয়মিত আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন কিংবা বিশেষভাবে তিস্তাসহ কিছু নদীর পানির বিষয়টি উল্লেখ করে থাকে। এর বাইরে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা ও সীমান্ত পরিস্থিতিও গুরুত্ব পায়। পাশাপাশি সাম্প্রতিক ইস্যুগুলো এবার বেশি প্রাধান্য পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম বলেছেন, দুই দেশের মধ্যকার ‘কমন বিষয়’গুলোই আলোচনায় আসবে। সীমান্ত, বাণিজ্য, কানেকটিভিটি, পানির মতো অনেক বিষয় দুই দেশের আলোচনায় সাধারণভাবে থাকে। তবে এজেন্ডায় শেষ পর্যন্ত কী থাকবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট উইং কাজ করছে।
অন্যদিকে সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূতরা বলছেন, রাজনৈতিক ইস্যুতে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিক্ততার জায়গা নেই। তাই সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ-ভারত স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক সচল পর্যায়ে নিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন দুই সচিব।
বৈঠক বিষয়ে গত বুধবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, এটা খুবই স্পষ্ট, আমরা চাই ভালো সম্পর্ক। তবে সেটা ‘রেসিপ্রোকাল’ হতে হবে, দুই পক্ষকেই চাইতে হবে এবং সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
সরকার পতনের পর শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান এবং সংখ্যালঘু ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও ভারতের নাম উল্লেখ করে নানা মন্তব্য করেছেন, যা ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভারতবিরোধী প্রচার লক্ষ করা যাচ্ছে। আবার বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ব্যাপকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে—ভারতীয় মিডিয়ায় এমন প্রচারেও ক্ষোভ প্রকাশ করা হচ্ছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সরকারও এ ধরনের খবর সত্য নয় বলে দাবি করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার দেশের সব রাজনৈতিক দল এবং বৃহস্পতিবার ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক করেছেন। আবার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এবারের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নেতাদের পক্ষ থেকে ভারতকে নিয়ে যেসব বক্তব্য-বিবৃতি এসেছে, তাতে ভারতের দিক থেকেও নিরাপত্তা ইস্যুতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করছেন।
সর্বশেষ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে নির্যাতনসহ বেশকিছু অভিযোগ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত অতিরঞ্জিত এবং অসত্য খবর ধরে দেশটির সরকার যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাতে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া অতিসম্প্রতি উভয়ের জাতীয় পতাকার অবমাননা উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে নিয়েছেন। যার রেশ ধরেই ২ ডিসেম্বর আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠন হামলা করে, যাকে ‘পূর্বপরিকল্পিত’ বর্ণনা করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ। ওই হামলার পর থেকে বাংলাদেশ জুড়ে তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে।
এরই মধ্যে হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মাকে গত মঙ্গলবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। আবার ভারতের কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফিরে এসেছেন। দুদেশই ভিসা সীমিত করেছে দুদেশের নাগরিকদের জন্য। যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর প্রণয় ভার্মা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কোনো নির্দিষ্ট একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক মূল্যায়ন করা যাবে না। তিনি বলেছিলেন, আমরা আমাদের আলোচনা চলমান রাখব। বৈঠক তারই একটা অংশ। আমাদের বিস্তৃত সম্পর্ক রয়েছে, পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত সাব্বির আহমেদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, সচিব পর্যায়ের বৈঠকে সাধারণত কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে এমন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে দুদেশের সুবিধা অনুযায়ী বৈঠক হয়ে থাকে। বৈঠকগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়ে থাকে। এবারের বৈঠকে কতটুকু বাণিজ্য, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো উন্নত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে গঠনমূলক। এর বাইরে মতের অমিলগুলো নিয়েও আলোচনা হতে পারে। এবার দুদেশের সম্পর্কে কিছু নতুন বিষয় এসেছে, যেখানে জটিল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। আমাদের অনেক কিছুই ভারত থেকে আমদানি করতে হয়।
সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, অবশ্যই সাম্প্রতিক হামলার বিষয় আলোচনায় আসবে। তাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উপস্থিত থাকা অবস্থাতেও হামলা হয়েছে, যা দুঃখজনক। আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। ভারতের গণমাধ্যমে চিন্ময় দাসের ঘটনাকে বড় করে দেখানো হচ্ছে, তবে সঠিক বিষয়টি আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জানানো উচিত।
ভিসা সংকুচিত করা প্রসঙ্গে এই কূটনীতিক বলেন, অবশ্যই ভিসা নিয়ে আলোচনা হবে। ভিসা অনেকটাই বন্ধ। চিকিৎসাজনিত কারণে অনেকেই ভারতে যান, যা সম্পূর্ণ ইমার্জেন্সি, এখন তা অনেকটাই সীমিত। কীভাবে এটি স্বাভাবিক হয়, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাণিজ্য প্রতি বছরই আলোচনায় আছে। আমদানি আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে করা লাগে। এর বিকল্প এক দিনেই হবে না। আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে যেন আমাদের রপ্তানি করা পণ্য তারা আরও নেয়। এলসিসহ নানা বাধা যেন মোকাবিলা করা যায়, এসব নিয়ে আলোচনা হবে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, আসলে এখন যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভারতের সঙ্গে যে উত্তেজনা, তা চলছে। সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনেকটাই ফরমাল হওয়ার কথা। দুদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
ভারত আগেও যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, আশা করি এবারও তা করবে। সবাইকেই মনে রাখতে হবে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উভয় দেশের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে। তাই আমাদের পক্ষ থেকে আমরা স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করব আর ভারত তাদের স্বার্থ দেখবে। আশা করি উভয়ই তাদের সাম্প্রতিক সমস্য বোঝার চেষ্টা করবে।
উত্তেজনা শিথিল হবে কি না তা বোঝা যাবে এই বৈঠকের পর? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, উত্তেজনা চলছে, তবে খুব না। দুদেশেরই লক্ষ রাখতে হবে যেন তৃতীয় কারণে সম্পর্ক নষ্ট না হয়। চাইলেই তো আর প্রতিবেশী পাল্টানো যায় না। তাই দুপক্ষকেই সমঝোতার পথ বেছে নেওয়া উচিত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, দুদেশের চলমান সংখ্যালঘু পরিস্থিতি, আগরতলা, কলকাতা মিশনে হামলা সংক্রান্ত বিষয়, ভারতের ভিসা কার্যক্রম স্বাভাবিক করা, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, আমদানি সহজ করা, পণ্যের শুল্ক কমানো প্রসঙ্গ, সীমান্ত হত্যাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।