সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেছেন, বিগত সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনই ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এ সময় কোনো কার্যকর বিরোধী দল ছিল না। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শুধু রাবার স্টাম্পের মতো কাজ করতেন। ফলে এলাকায় না গিয়ে তারা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কাজে সময় ব্যয় করেছেন।
গতকাল শনিবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) আয়োজিত বার্ষিক সম্মেলনে একক বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বিআইডিএস কনফারেন্স অন ডেভেলপমেন্ট (এবিসিডি) ২০২৪’ শীর্ষক সম্মেলনে এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ, গবেষক, এনজিও কর্মীসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
রেহমান সোবহান বলেন, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অগণতান্ত্রিক। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যেন সব ক্ষমতা চলে গেছে। সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ এলাকায় রীতিমতো জমিদার হয়ে যান। ফলে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় সরকার অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। পুরো ব্যবস্থাটি অগণতান্ত্রিক হয়ে গেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা অভিজাতদের কাছে চলে গেছে। ব্যবসায়ীরা সংসদে শক্তিশালী হয়ে গেছে।
রেহমান সোবহান বলেন, দেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় গভীর কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। তিনি বলেন, সবাই বৈষম্য দূর করার কথা বলছে। কিন্তু অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া এটা কমানো মুশকিল। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ যেমন—দুর্নীতি, প্রতিষ্ঠানের রাজনীতিকীকরণ এবং শিক্ষাব্যবস্থার অবক্ষয়। সাম্প্রতিক উন্নয়ন নয়, বরং দশকের পর দশক ধরে সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে গেঁথে আছে এই চ্যালেঞ্জগুলো। তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার কারণে এই সমস্যাগুলো কাঠামোগত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বিগত সরকারের ব্যর্থতার ফলেই এসব সমস্যা তৈরি হয়েছে। এখন এসব সমস্যা সমাধানের জন্য নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতা সংশোধন করা অপরিহার্য। তিনি বলেন, ন্যায়-সংগত ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন করতে হবে, যা দীর্ঘকাল ধরে ধারাবাহিক শাসন দ্বারা উপেক্ষা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার প্রণীত অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, স্বজনতোষী অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত অলিগার্কদের অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান ও গুণগত মান নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও গত কয়েক দশকে দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের গতি ভালো ছিল বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, দারিদ্র্যের বহুমুখী সূচকেও বাংলাদেশ ভালো করেছে। মানব উন্নয়নেও ভালো করেছে। শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনেও দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়টি নিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন উল্লেখযোগ্য। সুশাসনের অভাব থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যের হার ৫৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নিয়ে আসা যে কোনো বিচারে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান।
রেহমান সোবহানের মতে, বাংলাদেশে উচ্চ বৈষম্যের সমাজে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। উচ্চপর্যায়ের অন্যায্যতা আছে এখানে। রাষ্ট্রীয় নীতির মাধ্যমেই বৈষম্য ছড়াচ্ছে। সরকারের আর্থিক নীতির মধ্যমে সুশাসনের অভাব আছে। তিনি এ বিষয়ে একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, প্রথমে ঋণখেলাপি হয়; পরে তা পুনঃতফসিল করা হয়। শেষ পর্যন্ত তা অবলোপন করা হয়। এভাবে একটি অন্যায্য সমাজ গড়ে তোলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাজেটীয় ব্যবস্থার মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পুনঃঅর্থায়ন করা হচ্ছে। এতে করে খেলাপিরা সুবিধা পাচ্ছেন। অন্যদিকে সরকারি টাকার বণ্টন হচ্ছে ঋণখেলাপিদের বাঁচাতে।
বাজার ব্যবস্থায় সিন্ডিকেটকে ‘ভূত’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন রেহমান সোবহান। তাই ক্ষুদ্র চাষি বা উৎপাদকদের সংশ্লিষ্ট কৃষি-সংক্রান্ত ব্যবসায় অংশীদারত্ব নিশ্চিত করার সুপারিশ করেন তিনি। একইভাবে পোশাক শ্রমিকদেরও কারখানায় অংশীদারত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেন।
পুষ্টিমান, শিশুমৃত্যু, পড়াশোনার সময়, পানের পানির প্রাপ্যতা, আবাসন—এসব ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন রেহমান সোবহান। এ বাস্তবতায় তার মত, গবেষকদের কাজ হবে বাংলাদেশ প্যারাডক্সের নতুন রূপের সন্ধান করা। এত দিন সুশাসনের অভাবের মধ্যে কীভাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা নিয়ে ছিল বিস্ময়। এখন দেখতে হবে, এ ধরনের অসম সমাজ ও অপশাসনের মধ্যে কীভাবে দারিদ্র্য বিমোচন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে এতটা ভালো করল বাংলাদেশ। তার বিশ্বাস, এই গবেষণা করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন।
অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা করে রেহমান সোবহান বলেন, অসমতা পরিমাপের ক্ষেত্রে শুধু খানা আয়-ব্যয় জরিপের পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হচ্ছে; এর বাইরে কেউ যাচ্ছে না। তার মত, এ ক্ষেত্রে আয়করের বিবরণী গুরুত্বপূর্ণ আকার। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, খানা আয়-ব্যয় জরিপে শীর্ষ আয়ের মানুষের যে মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে, তা হলো ১০ লাখ টাকার সম্পদ ও মাসিক ৩০ হাজার টাকা আয়। এ সম্পদ এবং আয় গুলশান ও বারিধারার বেশিরভাগ গাড়িচালকেরই আছে। ফলে এই মানদণ্ড বিচার করা হলে আমাদের মতো অনেক মানুষই পরিসংখ্যান থেকে হারিয়ে যাবে। ফলে গবেষকরা যা করছেন, তা মূলত আলংকারিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের বলে মনে করেন তিনি। রেহমান সোবহান আরও বলেন, সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। কিন্তু সেই বৈষম্যের চরিত্র যথাযথভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে না। কোথায় কোথায় কোন খাতে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, তা নিরূপণ করা গেলে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।
অনুষ্ঠানে বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, বৈষম্য নিরসনে সংস্কার প্রয়োজন। এ জন্য সামাজিক খাতের সংস্কারকে প্রাধান্য দিতে হবে।
চার দিনব্যাপী সম্মেলনের প্রথম দিনে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেকসহ অনেক স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা বক্তব্য দেন। গতকাল শনিবার থেকে শুরু হওয়া বিআইডিএসের এই সম্মেলন আগামী মঙ্গলবার শেষ হবে।