‘বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করা কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে’ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী (এমপি) হতে পারবেন না—এই আইনটির বাতিল চান প্রবাসীরা। তারা বলছেন, প্রায় দেড় কোটি (সরকারি পরিসংখ্যান) বাংলাদেশি প্রবাসী রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না কেন? যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের টাকায় দেশ এগিয়ে যায়, তারা কেন পিছিয়ে থাকবেন? আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশ আছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছাড়া অন্য সব পদের নির্বাচনে দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা সত্ত্বেও যে কেউ প্রার্থী হতে পারেন ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। তাহলে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে এমন ‘অহেতুক’ প্রতিবন্ধকতা থাকবে কেন?
বেশ কয়েকজন প্রবাসী কালবেলাকে বলেছেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। ইতোমধ্যে এসব কমিশন কাজও শুরু করেছে। তেমনই রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে দ্বৈত নাগরিকত্ব আইনের যে বিধান রয়েছে, তা বাতিল এবং সংশোধন করা অত্যাবশ্যক।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শামসুল আলম সেলিম গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান নাগরিকত্ব আইনে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। বিগত সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে অনেকেই একাধিক দেশের নাগরিকত্ব থাকার পরও নির্বাচন করে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। প্রবাসীরা তো বাংলাদেশেরই নাগরিক। তাদের রেমিট্যান্স নিতে পারলে ভোট দেওয়া ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগও থাকতে হবে। তারাও আমাদের জাতি গঠনের কাজে অবদান রাখুক। সুতরাং সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতার বিষয়ে দ্বৈত নাগরিকত্ব আইনটির প্রয়োজনীয়তা দেখি না। অবিলম্বে আইনটি সংস্কার করে সবার জন্য নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত।’
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান এমন একাধিক প্রবাসী কালবেলাকে জানান, তারা অনেকেই বহুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাস করে আসছেন। প্রবাস জীবনে অনেকের বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা রয়েছে। এসব দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি কেউ বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে দেশের জন্য কল্যাণকর হবে। কারণ প্রবাসীদের বেশিরভাগই আর্থিকভাবে সচ্ছল। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে তারা দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে দেশের জন্য কিছু করতে চান। এ অবস্থায় দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা অবিলম্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বাতিল এবং সংশোধন করার আহ্বান তাদের। তা না হলে অবিলম্বে তারা নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কাছে এ বিষয়ে স্মারকলিপি দেবেন বলে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদের ৬৬ (১) ধারা মতে, ‘কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক হইলে এবং তাঁহার বয়স পঁচিশ বৎসর পূর্ণ হইলে এই অনুচ্ছেদের (২) দফায় বর্ণিত বিধান সাপেক্ষে তিনি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন। (২) কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি (ক) কোনো উপযুক্ত আদালত তাঁহাকে অপ্রকৃতিস্থ বলিয়া ঘোষণা করেন; (খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হইবার পর দায় হইতে অব্যাহতি লাভ না করিয়া থাকেন; (গ) তিনি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন...।’
জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন কালবেলাকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রবাসীদের অংশগ্রহণের বিষয়ে আইনটি অবিলম্বে বাতিল করা হোক। কেননা বিদেশে অনেকেই আছেন, যারা বিভিন্ন নির্দিষ্ট খাতে পারদর্শী এবং অভিজ্ঞ ও দক্ষ। তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিলে এবং তারা নির্বাচিত হলে তাদের মেধা ও যোগ্যতা এবং দক্ষতায় বাংলাদেশ লাভবান হবে। তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে মূল্যায়ন করা উচিত। কেননা একজন সাধারণ শিক্ষিত মানুষকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিংবা অর্থমন্ত্রী বানালে তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ না হলে সুচারুভাবে কার্য সম্পন্ন করতে পারবেন না। অতএব বিদেশি নাগরিকত্ব থাকলে কেউ নির্বাচন করতে পারবেন না, এটি সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
তিনি বলেন, অনেকেই উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশে গিয়ে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। আসলে তারা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। এর মানে এই নয় যে, তিনি বাংলাদেশের নাগিরক নন। তাদের মূল লক্ষ্য দেশসেবা ও দেশের জন্য কিছু করা। এখন দেশে নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন খাতের সংস্কার চলছে। দ্বৈত নাগরিকত্ব আইন বাতিল করে তাদের যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়।
মিল্টন ভূঁইয়া আরও বলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৬ জন নাগরিক কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের তো বাংলাদেশের নাগরিকত্ব রয়েছে। আমেরিকার মতো উদার গণতান্ত্রিক ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যদি দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে আপত্তি না করে, তাহলে আধুনিক বিশ্বে বাংলাদেশে এমন বৈষম্যমূলক আইন থাকবে কেন? সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে দ্বৈত নাগরিকত্ব আইন বাতিল করে সবাইকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া।
এদিকে, গত মাসের শুরুতে রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে গঠিত সংস্কার কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই বৈঠকে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে জানান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। বৈঠকে জানানো হয়—১. প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ২. অনুপস্থিত ভোটারদের জন্য পোস্টাল ব্যালট নিয়ে কাজ চলছে। ৩. জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে ভোটার তালিকার সমন্বয় করা হচ্ছে। ৪. নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে জোর দিচ্ছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন, এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ৫. ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে এবং পরামর্শ গ্রহণ করা হচ্ছে। এই পাঁচটি বিষয়ে সংস্কার অগ্রগতির কথা বদিউল আলম মজুমদার জানালেও দ্বৈত নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তন বা বাতিলের বিষয়ে কোনো কথা নেই।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী গিয়াস আহমেদ কালবেলাকে বলেন, কোনো শিক্ষার্থী, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী যারা বাংলাদেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা নিতে যান, তাদের বেশিরভাগই পরবর্তী সময়ে ওই দেশে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধার কারণে থেকে যান এবং নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। আজকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত ও মহাক্ষমতাধর রাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞ লোকদের নাগরিকত্ব দিয়ে তার দেশে কাজে লাগাচ্ছে। কোনো ব্যক্তি দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন শুধু প্রেসিডেন্ট ছাড়া। তাহলে বাংলাদেশের মানুষ কেন পারবে না।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রবাসীদের মধ্য থেকে ১০ ভাগ কোটা রাখার জন্য সরকারকে আহ্বান জানাব। সেটা সংসদ থেকে শুরু করে প্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে যেন কার্যকর করা হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সংস্কার করতে গেলে এই বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। এটা ছাড়া বাংলাদেশের সংস্কার হবে না।
উদাহরণ দিয়ে গিয়াস আহমেদ বলেন, কেউ একজন বাংলাদেশে বহুদিন ধরে নির্বাচন করছেন, আবার ব্যবসা করছেন। তার চোখে কিন্তু দুর্নীতি-অনিয়ম ধরা পড়বে না। অন্য কেউ যখন বিদেশ থেকে ঢাকার বিমানবন্দরে নামবেন, তার চোখে কিন্তু বিভিন্ন সমস্যা ধরা পড়বে। প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি প্রবাসী রয়েছেন। তারা তো বেশিরভাগই সাফিসিয়েন্ট। আমার নিজের প্রতিষ্ঠানে (যুক্তরাষ্ট্রে) বছরে ৭০-৮০ মিলিয়ন ডলার টার্ন আউট হয়। সরকারের কোনো কর্তাব্যক্তি আমাদের লাইসেন্স বা অন্য কিছু দেখতে এলে তাদের এক কাপ চা পর্যন্ত খাওয়ানো যায় না। তাহলে দুর্নীতির সুযোগ কোথায়? এমনকি অনিয়ম করলে ট্রাফিক পুলিশ আমাদের ধরে। গুরুতর হলে লাইসেন্স বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাকেও ঘুষ দেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা যখন বাংলাদেশে যাব, আমাদের মানসিকতা কিন্তু তেমনই হবে।
জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইমরানুল হক চাকলাদার কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ বিদেশে রয়েছেন। যাদের অনেকেই পড়াশোনাসহ নানা কারণে প্রবাস জীবন এবং কেউ কেউ নাগরিকত্ব বেছে নিয়েছেন। প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করছে এবং অর্থনৈতিক অবদান এবং রপ্তানির প্রসারে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সুতরাং প্রবাসী কারও দ্বৈত নাগরিক্ত থাকলেই তিনি বাংলাদেশে সংসদ সদস্য হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না, এটা অন্যায় এবং অযৌক্তিক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে দ্রুত অহেতুক এই আইন বাতিল কিংবা সংশোধন করে নির্বাচনে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।