নোয়াখালীর চাটখিলে ২০২০ সালের অক্টোবরে দুই শিশুসন্তানকে গলায় ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে জিম্মি করে প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই সময়ের আলোচিত ওই ঘটনার শিকার গৃহবধূ স্থানীয় ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক মজিবুল রহমান শরীফকে আসামি করে মামলা করেন। পুলিশ তদন্ত শেষে ওই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। ওই ঘটনার চার বছর পর গত ৩ নভেম্বর দেওয়া আদালতের রায়ে আসামি খালাস পেয়ে যান।
প্রায় ৬ বছর আগে জাল নোট রাখার অভিযোগে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ রাজধানীর পল্টন এলাকার হোটেল ‘বন্ধু’র ম্যানেজার ও শেফকে গ্রেপ্তার করে। ওই ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে আদালত দুই আসামিকে খালাস দিয়ে মামলা খারিজ করে রায় দেন।
শুধু এই দুটি ঘটনাই নয়, পুলিশের পরিসংখ্যানই বলছে, তদন্ত শেষে পুলিশ অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দিলেও আদালতের রায়ে ৭২ শতাংশ মামলাতেই আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। পুলিশের জমা দেওয়া চার্জশিটে বিচারে মাত্র ২৮ শতাংশ মামলায় শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে। গত জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন নিম্ন আদালতে রায় হওয়া মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে এ তথ্য বেরিয়ে আসে।
এত বেশিসংখ্যক মামলায় আসামির বিচার নিশ্চিত করতে না পারার বিষয়ে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশিরভাগ মামলা দায়েরের সময়েই ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। ভুয়া তথ্য দিয়ে মামলা দায়ের, ‘নির্দোষ’ ব্যক্তিদের আসামি করা, সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে তদন্ত না করা, ভুয়া সাক্ষী রাখা এবং বিচার চলাকালে সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারায় বেশিরভাগ মামলায় আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতায় গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়া, পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগ ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ঠিকঠাকভাবে মামলা পরিচালনায় ব্যত্যয় থাকায় অধিক মামলাতে আসামি খালাস পাচ্ছেন। এতে ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের এক বৈঠকে মামলার তদন্ত ও বিচারের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা হয়। তাতে নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় সাজা নিশ্চিতের চেয়ে খালাস হওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। ওই বৈঠকে মামলায় সাজার হার বাড়াতে তদন্ত কর্মকর্তা অনুপাতে মামলার ভারসাম্য করার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। জেলার পুলিশ সুপার, রেঞ্জ ডিআইজি এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারদের একটি মনিটরিং সেল গঠন করে সাজার হার বাড়াতে প্রতি মাসে এ বিষয়ে আলোচনা করার কথা বলা হয়।
কোন মাসে কত মামলা নিষ্পত্তি, সাজা ও খালাসের হার কত: পুলিশ সদর দপ্তরের বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিচার নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় সাজার হার ও খালাসের হার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী জুলাই মাসে সারা দেশে ৯ হাজার ৭৮টি মামলার বিচার নিষ্পত্তি হয়। অর্থাৎ আদালতে এই মামলাগুলোর রায় হয়েছে। ওই মাসে বিচার নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ২ হাজার ৮৫২টি মামলায় সাজা হয়, অর্থাৎ মোট বিচার নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় সাজার হার মাত্র ৩১ দশমিক ৪২ শতাংশ। তবে ৬৪ দশমিক ১৮ শতাংশ বা ৫ হাজার ৮২৬ মামলার আসামি খালাস হয়। ৪০০টি মামলা (৪ দশমিক ৪১ শতাংশ) অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি হয়।
পরিসংখ্যান বলছে, আগস্ট মাসে সারা দেশের আদালতগুলোতে ৬ হাজার ২১১টি মামলার বিচার নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৫৩৬টি মামলায় সাজা হয়, ৪ হাজার ৩০১টি মামলায় আসামি খালাস হয়। সে হিসাবে ওই মাসে ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ মামলায় সাজা নিশ্চিত হয় এবং ৬৯ দশমিক ২৫ ভাগ মামলায় আসামি খালাস হয়েছে। ওই মাসে ৩৭৪টি (৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ) মামলা অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি হয়।
সেপ্টেম্বর মাসে ৮ হাজার ২২৪টি মামলার রায় হলেও এর মধ্যে ১ হাজার ৮৩৯টি মামলায় সাজা নিশ্চিত হয় এবং ৫ হাজার ৮৬৮টি মামলায় আসামি খালাস হয়। সে হিসাবে ওই মাসে ২২ দশমিক ৩৬ শতাংশ মামলায় সাজা ও ৭১ দশমিক ৩৫ ভাগ মামলায় খালাস হয়। ওই মাসে ৫১৭টি মামলা (৬ দশমিক ২৮ শতাংশ) অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি হয়। ওই তিন মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতি মাসের বিচার নিষ্পত্তিতে সাজার চেয়ে খালাস হচ্ছে বেশি মামলায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশের আদালতগুলোতে মোট ২২ হাজার ২২২টি মামলার বিচার নিষ্পত্তি (সাজা ও খালাস) হয়। বিচার নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ৭১ দশমিক ৯৭ শতাংশ মামলায় আসামি খালাস হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী কালবেলাকে বলেন, নানা কারণেই মামলার রায়ে আসামি খালাস হচ্ছে। একটা মামলার রায় বাদী বা রাষ্ট্রপক্ষে যেতে সাক্ষী গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে সেটা হচ্ছে না। পুলিশের মাধ্যমে সমন জারি করেও সাক্ষী হাজির করা যাচ্ছে না।
রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, মাদকের মামলায় সিজার লিস্টে থাকা সাক্ষী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেখা যায়, পথচারী, বাড়ির নিরাপত্তা কর্মী বা ভাসমান লোক সিজার লিস্টে সাক্ষী করা হয়। অনেক সময় পর মামলার বিচারকাজ শুরু হলে এই ভাসমান সাক্ষী আর পাওয়া যায় না। এজন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের সাক্ষী করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। তা ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা বা যৌতুকের মামলাগুলোর বেশিরভাগই আদালতের বাইরে মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে। স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা করলেও বাইরে মীমাংসার পর তা চালাচ্ছেন না। সাক্ষী বা বাদী আদালতে আসেন না। তখন এসব মামলায় তো আসামি খালাস হবেই।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, মামলা দায়েরের শুরুতেই ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। ত্রুটিযুক্ত মামলায় ভালো চার্জশিটও আশা করা যায় না। এ ছাড়া ডাকাতি বা বাসায় চুরির মামলা হলে বাদীই কিন্তু সাক্ষীদের তালিকা দিয়ে থাকেন। অথচ সেই মামলার বিচার চলাকালে সাক্ষীরা ঠিকঠাক সাক্ষ্য দিতে পারছেন না। মারামারি বা সংঘর্ষের মামলাগুলোতে চিকিৎসা দেওয়া সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ওই মামলায় বড় সাক্ষী। কিন্তু বিচার চলাকালে তাকে সাক্ষ্য দিতে হাজির করা যায় না। এতে আসামি খালাস হয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়া, অনেক ক্ষেত্রে ভুল তদন্ত ও ভুয়া সাক্ষীর কারণে আসামি খালাস হয়ে যেতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, জেলা পর্যায়ে অনেক সময়ে খালাস হওয়া মামলাগুলো নিয়ে জজ, পুলিশ কর্মকর্তা ও পাবলিক প্রসিকিউটর পর্যায়ে মিটিং হয়। কেন খালাস হলো—এসব মিটিংয়ে তা নিয়ে আলোচনা হয়, অনেক ত্রুটি বেরিয়ে আসে। এই ত্রুটিগুলো বন্ধ করতে পরে আর কোনো পক্ষই কাজ করে না। এতে মামলায় সাজা নিশ্চিতের চেয়ে খালাস বেশি হচ্ছে।
কোন এলাকায় সাজার হার কেমন: আলোচিত তিন মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) থানাগুলোতে দায়ের মামলাগুলোয় গড়ে সাজার হার সবচেয়ে কম। পুলিশের ইউনিটগুলোর মধ্যে মাদকের মামলাতেও ডিএমপিতে সাজার হার সর্বনিম্ন। জুলাই মাসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বরিশাল মহানগরের থানাগুলোয় দায়ের মামলার বিচার নিষ্পত্তিতে সর্বোচ্চ প্রায় ৫১ ভাগ সাজা হয়েছে। রাজশাহী মহানগর পুলিশে (আরএমপি) ৪০ দশমিক ১৬ ভাগ এবং চট্টগ্রাম রেঞ্জের থানাগুলোতে প্রায় ৪০ ভাগ মামলায় সাজা হয়। ওই মাসে ডিএমপিতে ২২ দশমিক শূন্য ৮ ভাগ মামলায় সাজা হলেও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে (সিএমপি) ১৯ দশমিক ৪১ ভাগ এবং রংপুর রেঞ্জে ২৩ দশমিক ৪৮ ভাগ মামলায় সাজা হয়।
আগস্ট মাসে গাজীপুর মহানগর এলাকার থানাগুলোয় প্রায় ৬৭ ভাগ মামলায় সাজা হয়। ওই মাসে ডিএমপিতে ১৩ দশমিক ৩৬ ভাগ মামলায় সাজা হয়। এ ছাড়া সেপ্টেম্বর মাসে বরিশাল মহানগরে সর্বোচ্চ প্রায় ৪১ ভাগ মামলায় সাজা হয়। ডিএমপিতে মাত্র ১২ দশমিক ৮২ ভাগ মামলায় সাজা হয়।
মাদকের মামলাতেও কমছে সাজা পাওয়ার হার: তিন মাসের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায়ও সাজার হার কমছে। জুলাই মাসে বিচার নিষ্পত্তি হওয়া মাদকের ৫০ দশমিক ১৯ ভাগ মামলায় সাজা হয়। পরের মাসে তা ৪১ দশমিক ৫৯ ভাগ এবং সেপ্টেম্বরে মাদকের মামলায় সাজার হার ৩৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ হয়। এর মধ্যে জুলাইয়ে পুলিশের ইউনিটগুলোর মধ্যে রংপুর মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ প্রায় ৭৯ ভাগ মাদকের মামলায় সাজা হয়। পাশাপাশি ডিএমপিতে সর্বনিম্ন ২৮ দশমিক ৫৫ ভাগ মামলায় সাজা হয়। পরের মাসে রংপুর মহানগর পুলিশের থানাগুলোয় সর্বোচ্চ ৬৮ দশমিক ৪২ ভাগ মাদকের মামলায় সাজা হয় এবং ডিএমপিতে সর্বনিম্ন ১৭ দশমিক ১৮ ভাগ মামলায় সাজা হয়। সেপ্টেম্বরেও রংপুর মহানগর পুলিশের থানাগুলোয় সর্বোচ্চ প্রায় ৭৯ ভাগ মাদকের মামলায় সাজা হয় এবং এ মাসেও ডিএমপিতে সর্বনিম্ন ১৫ দশমিক ৭৫ ভাগ মামলায় সাজা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের অন্য একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, মামলায় সাজার হার যাতে বাড়ে, সেজন্য প্রতিনিয়তই তদন্ত কর্মকর্তাদের নিখুঁতভাবে তদন্ত ও চার্জশিট দিতে বলা হয়। বিষয়গুলো নিয়ে জেলা মনিটরিং সেলেও আলোচনা হয়। কিন্তু মামলায় সাজার হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গে প্রসিকিউশন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোরও আন্তরিকতা দরকার।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর কালবেলাকে বলেন, মামলায় খালাস বা সাজার হারের পরিসংখ্যান নিয়ে মন্তব্য নেই। তবে প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে তদন্ত কার্যক্রম যাতে সঠিক হয়, পুলিশ সদর দপ্তর সেই বিষয়ে বরাবরই ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। যাতে সুষ্ঠু তদন্ত হয় সেজন্য নজরদারি ও তদারকি থাকে। পাশাপাশি মামলার তদন্তের জন্য মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, চাঞ্চল্যকর বা তুলনামূলকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর তদন্তে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তরা নিবিড়ভাবে তদারকি করেন। সুষ্ঠু তদন্তের জন্য প্রতিনিয়তই ইনসার্ভিস ট্রেনিংয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে।