বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২ মাঘ ১৪৩১
জাকির হোসেন লিটন
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৬ এএম
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

সংলাপেই শান্তিপূর্ণ সমাধান

বিশেষজ্ঞ মত
সংলাপেই শান্তিপূর্ণ সমাধান

ভারত-বাংলাদেশের চলমান উদ্বেগ নিরসনে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি ও আলোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকাটা স্বাভাবিক। কখনো এ সম্পর্ক উষ্ণ এবং কখনো খানিকটা শীতলতা দেখা যায়; কিন্তু সেটি চরম সীমায় যাওয়া কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়। সেজন্য ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে বিরাজমান অস্থিরতা নিরসনে দুই দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনা বা সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে। কালবেলার সঙ্গে আলাপকালে তারা এ কথা বলেন।

সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করায় বাংলাদেশি জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে জানিয়ে তারা বলছেন, বিষয়টি বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা এবং অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি নিজেদের জন্য কিছুটা হুমকি মনে করছে। সেজন্য এ বিষয়টিও দেশটি ভেবে দেখতে পারে। একই সঙ্গে ভারতের মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে বিষোদ্গার করছে, তা বন্ধে সেই দেশের সরকারকেই আগে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলছেন তারা। পাশাপাশি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণের পরামর্শও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা কমিয়ে দেওয়া এবং এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সরকারকে একপেশে সমর্থনের অভিযোগ উঠে দেশটির বিরুদ্ধে। এ ছাড়া পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অতীতের দ্বিপক্ষীয় নানা ইস্যুতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে। অন্যদিকে আগস্টের পর বাংলাদেশে ঘটা কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে বেশ বড় ইস্যু হিসেবে বেছে নেয় প্রতিবেশী দেশ ভারত। বিশেষ করে সংখ্যালঘু ইস্যুতে দেশটির গণমাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অতিরঞ্জিত তথ্য তুলে ধরা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আন্দোলন এবং সর্বশেষ ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের পর এটি আরও জোরালো হয়। বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে নানা তীর্যক মন্তব্য আসে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও উগ্র সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে। প্রতিবেশী দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভও দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ দেশটির বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন। এমনকি বাংলাদেশে শান্তিরক্ষা মিশন পাঠানোর দাবিও জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। সর্বশেষ উগ্র জনগোষ্ঠীর বিক্ষোভ থেকে সোমবার আগরতলায় বাংলাদেশের কনস্যুলার অফিসে হামলা এবং বাংলাদেশের পতাকায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বেনাপোলসহ বাংলাদেশের নির্দিষ্ট স্থল বন্দর দিয়ে কোনো পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেয় ভারতের আন্দোলনকারীরা। বাংলাদেশের সুতারকান্দি স্থলসীমান্ত দিয়ে উগ্র প্রতিবাদকারীরা বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টাও চালায়।

এতে বাংলাদেশেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সোমবার রাতে ভারতের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের এ ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানায়। উগ্রপন্থিদের বিক্ষোভে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আগরতলাসহ ভারতে বাংলাদেশের সব মিশনের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য আগেই দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নোট পাঠানো হয়েছে। প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সরকারের উপদেষ্টারাও এসব ইস্যুতে নানা সমালোচনা করেছেন। সরকারের বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ভারত অস্থিরতা তৈরি করলে বাংলাদেশের মানুষও বসে থাকবে না। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল আরও কড়া ভাষায় বলেছেন, ভারতকে বুঝতে হবে এটা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল এক বিবৃতিতে ভারতীয়দের বাংলাদেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

এদিকে বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে হামলার ঘটনাকে ভারতীয় মিডিয়ায় অপপ্রচারের ফল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে সংলাপে বসতে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল দেশটির হাইকমিশনারকে তলব করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, নিরাপত্তাহীনতার কারণে আগরতলার কনস্যুলার সেবাও বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশে সরকার। তবে প্রতিবেশী ভারত এ ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগরতলার ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলেছে, ‘কূটনৈতিক ও কনস্যুলার সম্পত্তি কোনো অবস্থাতেই লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়।’ পাশাপাশি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সাতজনকে গ্রেপ্তার এবং দায়িত্বে অবহেলার জন্য চার পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে ভারত। আর ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, ‘একটি ইস্যু দিয়ে সম্পর্ক মূল্যায়ন করা যাবে না। তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।’ এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের নিরাপত্তা আরও জোরদার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সীমান্তে যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ও অপতৎপরতা রোধে প্রস্তুত ও সতর্ক থাকার কথা জানিয়েছে বিজিবি।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে নয়াদিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। এরপর ভারত বাংলাদেশের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনা নিরসনে উভয় দেশের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সেক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার টেবিলকে বেছে নেওয়ার পরামর্শ তাদের। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ছাড়া কাউকে এসব বিষয়ে বাহাসে না জড়ানোর কথাও বলছেন তারা।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘সংখ্যালঘু ইস্যু একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা। প্রতিবেশী দেশটি এ ইস্যুতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সেজন্য ভারতের হাইকমিশনারকে আরও আগেই তলব করে কথা বলা প্রয়োজন ছিল।’

সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখতে উভয় দেশের আলোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতির অবনতি হলে তা উভয় দেশের জন্যই ভয়াবহ হবে। সেজন্য আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান করা উচিত। এসব বিষয়ে দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে কথা বলতে হবে এবং যোগাযোগ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া উভয় দেশে কেউ যাতে কথা বলতে না পারেন, সেটিও গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বশেষ ভারতের সাংবাদিকদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ করতে হবে। তারা সরেজমিন এসে প্রতিবেদন তৈরি করুক। বেসরকারি পর্যায়েও তাদের নিয়ে আসা যেতে পারে। তাহলে তাদের ভুল ভাঙবে।’

সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে হলে কূটনীতিকেই বেছে নিতে হবে এবং সেটাই আসল সূত্র। এ ক্ষেত্রে উভয় দেশের সরকারের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। বসতে হবে আলোচনায়। শুধু উত্তেজনা দেখা দেবে, সীমান্তে মানুষ হত্যা হবে আর সাদা পতাকা বৈঠক হবে, সেটা সমাধান নয়। দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে উইন উইন সিচুয়েশন করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দেশে অবস্থান করায় বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা এবং অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি নিজেদের জন্য কিছুটা হুমকি মনে করছে। তারা মনে করছে, ভারত যা কিছু করছে তা শেখ হাসিনাকে রক্ষা অথবা তার প্রেসক্রিপশনেই করছে। সেজন্য এ বিষয়টিও দেশটি ভেবে দেখতে পারে।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, উত্তেজনা প্রশমনে উভয় দেশকেই উদ্যোগী হওয়া দরকার। ভারতের মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে বিষোদ্গার করছেন, তা বন্ধে সেই দেশের সরকারকেই আগে উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক শীতল থেকে উষ্ণ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সারজিস আলমের ফেসবুক স্ট্যাটাস

জামায়াত আমিরের ফেসবুক স্ট্যাটাস

এবার আ.লীগ নিয়ে বিএনপির নতুন অবস্থান

সার বিক্রিতে আ.লীগ নেতার অনিয়ম, অতঃপর... 

এবার সুধা সদনেও আগুন

সৌদি আরবে বাংলাদেশি যুবক খুন

‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে শহীদদের রাষ্ট্রীয় খেতাব দেবে বিএনপি’

সাংবাদিকদের ওপর হামলা, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা বহিষ্কার

কুষ্টিয়ায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো হানিফের বাড়ি

মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ইকবাল, সম্পাদক মিন্টু

১০

৩২ নম্বরের সর্বশেষ অবস্থা

১১

১৫ বছরে ১৩ বার বদলি হন ডা. পলাশ

১২

নির্বাচনের আগেই গণহত্যার বিচার সম্পন্ন করুন : জামায়াত নেতা রফিকুল

১৩

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ভাঙচুর, খালেদা জিয়াকে স্মরণ করলেন ইলিয়াস

১৪

৩২ নম্বর ভেঙে মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা পিনাকীর

১৫

টেকনাফে ৫ কাঠুরিয়াকে অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি

১৬

মেডিকেলে চান্স পাওয়া জয়ের পাশে দাঁড়ালেন ইউএনও

১৭

সারজিস আলম আহত

১৮

হাসনাত বললেন ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ

১৯

ফেনী জেলা যুবদলের নতুন কমিটি ঘোষণা

২০
X