নজিরবিহীন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানিতে। শুল্ক ফাঁকি দিতে গাড়ির ম্যানুফ্যাকচারিং ইয়ার থেকে মডেল নম্বর পরিবর্তন করে গাড়ি খালাস করেছে একটি অসাধু চক্র। আর জাল দলিলাদি দিয়ে রেজিস্ট্রেশনও করে নিয়েছে। এভাবে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকার শুল্ক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এরই মধ্যে একটি বিএমডব্লিউ জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা। সন্ধানে আছে আরও পাঁচটি গাড়ি। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে বেশকিছু বিলাসবহুল গাড়ি জালিয়াতির মাধ্যমে খালাস করে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র। গাড়িগুলো যাচাই-বাছাই ছাড়া আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের তথ্যের ভিত্তিতেই খালাস করেছেন শুল্ক কর্মকর্তারা। এতে প্রায় ২০ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি রয়েছে বলে আশঙ্কা শুল্ক কর্মকর্তাদের। এই গাড়ির মধ্যে বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জ, সাফারির মতো বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। এসব গাড়ি আমদানি থেকে শুরু করে মূল্য ঘোষণায়ও বড় জালিয়াতি রয়েছে। এরই মধ্যে তিনটি গাড়ির তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। এসব গাড়ি জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণায় খালাস করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের দুটি ধাপ অর্থাৎ পরীক্ষণ ও শুল্কায়ন গ্রুপ থেকেও কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই হয়নি। ফলে শুল্ক ফাঁকি দিয়েও গাড়ি খালাসে সক্ষম হয়েছে এই অসাধু সিন্ডিকেট। শুধু খালাস নয়, মডেল নম্বর উল্লেখ না করে গাড়ির রেজিস্ট্রেশনও নিয়েছে এই সিন্ডিকেট। এ ছাড়া আরও পাঁচটি গাড়ির তথ্য চেয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে চিঠি দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর উল্লেখ করে চিঠি দেওয়া হলেও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস বিল অব এন্ট্রির কোনো তথ্য দিতে পারেনি। এসব গাড়ির কোনো তথ্য নেই বলেও জানানো হয়েছে শুল্ক গোয়েন্দাকে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান কালবেলাকে বলেন, যারা মিথ্যা ঘোষণায় গাড়ি আমদানি করে শুল্ক ফাঁকি দিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তাদের শুল্ক পরিশোধ করতে চিঠি দেওয়া হবে। গাড়ির মডেল ইয়ার পরিবর্তন করা এবং জালিয়াতির কারণে আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলেও জানান এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
শুল্ক গোয়েন্দার এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চট্টগ্রামভিত্তিক টোকিও এন্টারপ্রাইজ নামের একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর বিএমডব্লিউর সিরিজের একটি গাড়ি আমদানি করে। প্রতিষ্ঠানটি বিএমডব্লিউর সেভেন সিরিজের গাড়িকে ৫ সিরিজ হিসেবে ঘোষণা দেয়। আর সেই হিসেবে গাড়িটির মূল্য ঘোষণা করে ৪০ হাজার ডলার। কিন্তু অনুসন্ধানে গাড়িটি ৭ সিরিজের বলে প্রমাণ পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা, যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ১ লাখ ইউরো বা ১ লাখ ২০ হাজার ডলার। আর গাড়িটি নন-হাইব্রিড হলেও হাইব্রিড হিসেবে শুল্কায়ন করা হয়। এই খালাসের প্রক্রিয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন তৎকালীন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান, রাজস্ব কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন হাজারী, সহকারী কমিশনার নুরুন নাহার লিলি ও অতিরিক্ত কমিশনার জিয়াউদ্দীন।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার (বর্তমান কমিশনার) কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীন কালবেলাকে বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে অতিরিক্ত কমিশনার পর্যায়ে গাড়ি দেখার তেমন সুযোগ নেই। এসব ফাইল রাজস্ব কর্মকর্তা এবং উপকমিশনার পর্যায়ে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। আমরা শুধু ফাইল ওয়ার্ক করে থাকি। আর গাড়িটি না দেখার কারণে যেভাবে ফাইল এসেছে, সেভাবেই করা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, শুধু টোকিও এন্টারপ্রাইজ নয়, নাগোয়া করপোরেশনও সেভেন সিরিজের বিএমডব্লিউ গাড়ি ৫ সিরিজ হিসেবে কম মূল্যে শুল্কায়ন করেছে। এই ধরনের তিনটি সেভেন সিরিজের গাড়ি ৫ সিরিজ উল্লেখ করে কম মূল্যে শুল্কায়ন করা হয়েছে। এই গ্রুপের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তৎকালীন উপকমিশনার নূর উদ্দিন মিলন। তিনি কালবেলাকে জানান, বিষয়টি পাঁচ-ছয় বছর আগের, তাই সঠিক করে বলতে পারছেন না। এই গ্রুপের তদারকি কর্মকর্তা ছিলেন তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার (বর্তমানে এনবিআরের প্রথম সচিব) শামসুজ্জামান। তিনি কালবেলাকে বলেন, আমি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বেশ কয়েক বছর আগে দায়িত্বরত ছিলাম। আর গাড়ির গ্রুপে থাকলেও আমি তদারক কর্মকর্তা ছিলাম। যারা পরীক্ষণ করেছেন, তারাই বিষয়টি নিয়ে ভালো বলতে পারবেন।