অন্তর্বর্তী সরকার দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিলেও কার্যত অনুসন্ধান কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৮ সালের মধ্যে ১০০ কূপ খনন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে অনুসন্ধান, মূল্যায়ন ও উন্নয়ন কূপ। প্রায় তিন মাস আগে ২০টি কূপের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদনের জন্য জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এবং পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। কিন্তু এতদিন হলেও এসব প্রকল্পের অনুমোদন মেলেনি। এই অবস্থায় পিছিয়ে পড়ছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিপিপি অনুমোদনের পর দরপত্র করে কাজ শুরু করতে পাঁচ থেকে ছয় মাস সময় লাগে। ডিপিপি অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় দেরি হওয়ার কারণে ২০২৮ সালের মধ্যে ১০০ কূপ খননের যে পরিকল্পনা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন না হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে এই খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি খাতে ডিপিপি অনুমোদন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ডিপিপি অনুমোদন প্রক্রিয়া দেরি হওয়ার কারণেই এই খাতে বিশেষ আইন করেছিল। এখন বিশেষ আইন স্থগিত হয়েছে। এ অবস্থায় জ্বালানি খাতের ডিপিপিগুলোর অনুমোদন দ্রুত হওয়া প্রয়োজন। পরিকল্পনা কমিশনকে অন্য প্রকল্প ফেলে রেখে জ্বালানি খাতের প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, আমরা অনুমোদনের জন্য ২০টি কূপের ডিপিপি জ্বালানি বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠিয়েছি। কিন্তু এগুলোর অগ্রগতি নেই। তিনি বলেন, ডিপিপি অনুমোদন না হওয়ায় পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম পিছিয়ে পড়ছে। আমাদের পাঁচটি রিগ (খনন যন্ত্র) বসে আছে। আরও একটি রিগ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ডিপিপি অনুমোদন দেরি হলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন দেরি হবে।
জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, অন্যান্য খাতের সঙ্গে জ্বালানি খাতের ডিপিপি মেলালে হবে না। আমরা ডিপিপি অনুমোদনের আগেই অনেক কাজ এগিয়ে রাখি। যাতে করে ডিপিপি অনুমোদন হলেও কাজ শুরু করা যায়। তা নাহলে ডিপিপি অনুমোদনের পর পাঁচ-ছয় মাস লেগে যায় কাজ শুরু করতে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক, জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন কালবেলাকে বলেন, জ্বালানি খাতের ডিপিপি দ্রুত অনুমোদন হওয়া প্রয়োজন। অনুমোদন প্রক্রিয়া দেরি হওয়ার কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ আইন করে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও যদি একই অবস্থা হয়, তাহলে আমরা তো আগের জায়গায় রয়ে গেলাম। তিনি বলেন, যারা ডিপিপি নিয়ে কাজ (ডিল) করে, তাদের প্রাধান্য (প্রায়োরিটি) দিতে হবে। না হলে পুরো দেশকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। কারণ, জ্বালানি খাত অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তাই অন্যসব ফেলে রেখে জ্বালানি খাতের ডিপিপির অনুমোদন ত্বরিত গতিতে দেওয়া প্রয়োজন।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, সিলেটের রশিদপুর-১১ অনুসন্ধান কূপ খনন প্রকল্পটি চলতি বছরের ১ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০২৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ করা কথা। এজন্য প্রকল্পটির ডিপিপি অনুমোদনের জন্য গত সেপ্টেম্বরে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে পাঠানো হলেও সংশোধন করে ফের পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে সংশোধিত ডিপিপি গত ১৪ অক্টোবর জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়। এর ১০ দিন পর গত ২৪ অক্টোবর জ্বালানি বিভাগ থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত তা অনুমোদন হয়নি। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। একইভাবে সিলেটের ডুপিটিলা-১ ও কৈলাসটিলা-৯ অনুসন্ধান কূপ খনন প্রকল্পের ডিপিপি ১৪ অক্টোবর জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়। পরে জ্বালানি বিভাগ থেকে গত ২৪ অক্টোবর পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়, যা এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি চলতি বছরের ১ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০২৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ করার কথা। ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৪৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
তিতাস ও কামতা গ্যাসক্ষেত্রে চারটি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ খনন প্রকল্পের ডিপিপি গত ২০ অক্টোবর জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়। প্রকল্প প্রস্তাবনা এখন জ্বালানি বিভাগেই আটকে আছে। এখনো পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়নি। প্রকল্পটি চলতি বছরের ১ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০২৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা।
তিতাস ও বাখরাবাদ ফিল্ডে দুটি গভীর অনুসন্ধান কূপ খনন প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের জন্য গত ১৬ অক্টোবর জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়। কিন্তু ডিপিপি এখনো জ্বালানি বিভাগেই পড়ে আছে। কোনো অগ্রগতি নেই। প্রকল্পটি আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু করে ২০২৭ সালের ৩০ জুন শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮২৩ কোটি টাকা।
শ্রীকাইল ডিপ-১, মোবারকপুর ডিপ-১ ও ফেঞ্চুগঞ্জ সাউথ-১ তিনটি অনুসন্ধান কূপ খনন প্রকল্পের ডিপিপি গত ১ অক্টোবর অনুমোদনের জন্য জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে। পরে ৮ অক্টোবর জ্বালানি বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও এখনো অনুমোদন মেলেনি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।
চারটি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ (শাহবাজপুর-৫ ও ৭ নং ভোলা নর্থ-৩ ও ৪) এবং একটি অনুসন্ধান কূপ (শাহবাজপুর নর্থ ইস্ট-১) খনন প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের জন্য গত ১২ আগস্ট জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়। জ্বালানি বিভাগ থেকে গত ২২ আগস্ট অর্থ বিভাগে পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত এর কোনো অগ্রগতি নেই। ১ হাজার ৮৬৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছিল চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৭ সালের ৩১ মার্চ। অনুমোদন না হওয়ায় এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের সময়ও পেছাতে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।