নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীনসহ সব কমিশনারকে স্বাগত জানিয়েছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা প্রত্যাশা ব্যক্ত করে কালবেলাকে বলেন, দেশের ক্রান্তিকালে নতুন ইসির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ এবং পাহাড়সম দায়িত্ব। কেননা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো আগামীতে দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। সেই লক্ষ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে সরকার। দেশের সব জনগণ এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। এজন্য সদ্য গঠিত ইসির দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক।
তারা বলেন, যাদের সমন্বয়ে নতুন ইসি গঠন হয়েছেন তাদের বেশিরভাগের নাম রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তাব করেছিল। নেতৃবৃন্দ মনে করেন, নতুন ইসি স্বাধীনভাবে ও দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকে দেশের স্বার্থে স্বীয় দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হবে। পতিত স্বৈরাচার সরকারের আজ্ঞাবহ পূর্ববর্তী নির্বাচন কমিশনারদের পরিণতি থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীনকে সিইসি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহবুদ্দিন। এ ছাড়া অন্য একটি প্রজ্ঞাপনে চার কমিশনারের নিয়োগের বিষয়টিও জানানো হয়েছে। চার কমিশনার হলেন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব বেগম তাহমিদা আহমেদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মোহাম্মদ সানাউল্লাহ।
জানা গেছে, সিইসি হিসেবে বিএনপি চলতি মাসের শুরুতে অনুসন্ধান কমিটির কাছে যে দুজনের নাম প্রস্তাব করেছিল তার মধ্যে এ এম এম নাসির উদ্দীনের নাম ছিল। তিনি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে অবসরে যান তিনি। তিনি বিসিএস ১৯৭৯ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। এ ছাড়া সিইসি পদে বিএনপির দেওয়া তালিকায় আরেকজনের নাম ছিল, তিনি শফিকুল ইসলাম। আবার বিএনপির মিত্র দলগুলোর বেশির ভাগের তালিকাতেও এই দুজনের নাম ছিল।
নতুন ইসি গঠন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গতকাল কালবেলাকে বলেন, কারও পদলেহন না করে, নতুন নির্বাচন কমিশন জনগণের ভোটাধিকার ফেরাতে কাজ করুক, এমনটাই আমাদের চাওয়া।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা আমাদের পরামর্শ জমা দিয়েছিলাম। সরকার যা ভালো মনে করেছে তারা সেটি করেছে। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে পারলেই ভালো। তারা যেন সে দায়িত্ব পালন করে—এমনটাই আমরা আশা করি।
যাদের সমন্বয়ে ইসি গঠিত হলো তারা কি আপনাদের প্রস্তাবনায় ছিল—এমন প্রশ্নে মিয়া পরওয়ার বলেন, এটা তো বলা যাবে না। এসব গোপন বিষয়। আমরা বলছি, সরকার যা ভালো মনে করেছে, সেটি তারা করেছে। এখন নতুন ইসি জাতির প্রত্যাশা পূরণ করবে, এটাই প্রত্যাশা।
গণতন্ত্র মঞ্চের নতুন সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনের ওপর বিরাট দায়িত্ব। বিশেষ করে অবাধ, নিরপেক্ষ এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। নির্বাচন ব্যবস্থা যেখানে পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে, সেটাকে পুনর্গঠন করা; নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। পাশাপাশি গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থার একটি গণতান্ত্রিক সংস্কার করা। কাজেই পাহাড়সমান দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে কাজ করতে হবে। ফলে আমরা চাইব, দক্ষতা, যোগ্যতা, দূরদর্শিতা ও মেরুদণ্ড নিয়ে এই নির্বাচন কমিশন জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করবে। সেইসঙ্গে দেশের সত্যিকারের একটি গণতান্ত্রিক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন তারা উপহার দেবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে সাইফুল হক বলেন, যাদের দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন হলো তাদের ব্যাপারে অনেকেই ইতিবাচক। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল তাদের নাম প্রস্তাব করেছিল। তবে এ কথ্য সত্য যে, সরকার যদি সহযোগিতা না করে এবং নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা না থাকে তাহলে ইসিতে ফেরেশতা বসিয়ে দিলেও লাভ নেই। রাজনৈতিক দল, সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের বিরাট দায়িত্ব। এটি একটি সম্মিলিত ঐকতান (অর্কেস্ট্রা)।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি কালবেলাকে বলেন, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। ফলে জাতি নতুন নির্বাচন কমিশনের কাছে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা করে এটাই স্বাভাবিক। কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করলে আরও ভালোভাবে মন্তব্য (কমেন্ট) করা যাবে।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, আমরা আশা করছি, নবগঠিত নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এমনকি নিরপেক্ষভাবে তাদের ওপর অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব পালন করবে।
এদিকে, নতুন ইসি গঠিত হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করে শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। গতকাল এক বিবৃতিতে দলটির মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান নবনিযুক্ত সিইসিসহ অন্য কমিশনারদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। তারা সততা, নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করবেন বলে আমরা আশাবাদী। বিগত ১৬ বছর নির্বাচন কমিশন দলীয় অনুগত কমিশনে পরিণত হয়েছিল। জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষার পরিবর্তে নির্বাচন নিয়ে তামাশা করেছিল। অতীতের অবস্থা ফিরে আসুক, জনগণ তা চায় না। নতুন নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ, সাহসিকতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি। নেতৃদ্বয় আরও বলেন, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা করবে।
খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের গতকাল এক যুক্ত বিবৃতিতে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনের অন্য সদস্যদের স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, আমরা নতুন সিইসিসহ সব কমিশনারকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আশা করছি, তারা স্বাধীনভাবে ও দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকে দেশের স্বার্থে স্বীয় দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হবেন। পতিত স্বৈরাচার সরকারের আজ্ঞাবহ পূর্ববর্তী নির্বাচন কমিশনারদের পরিণতি থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করবেন।
বিবৃতিতে এই দুই নেতা আরও বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনাররা একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কার্যভার গ্রহণের দিন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করবেন। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং সংস্কার কমিশনের সিদ্ধান্তগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করবেন। একটা যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।