শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর ছোট ভাই মো. শাহাবুদ্দিন আহমেদকে নিজের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) পদে নিয়োগ দেন মন্নুজান সুফিয়ান। আর ভাতিজি শামীমা সুলতানা হৃদয়কে মন্ত্রণালয়ের অধীন কেন্দ্রীয় তহবিলে সহকারী পরিচালক (এডি) পদে চাকরি দেন। কিছুদিনের মধ্যেই পুরো মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাবা-মেয়ের ‘নিয়ন্ত্রণ’। মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন দপ্তর এবং সংস্থার সব রকম নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিতে তাদের ইশারায় চলে জমজমাট ‘বাণিজ্য’। তাদের দাপটে তটস্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কখনো কখনো মন্নুজান সুফিয়ান নিজেও এই দুজনের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তাদের নামে অভিযোগ করেছেন। এরপরও তাদের তৎপরতা থেমে নেই। ফলে সহজ-সরল ও সৎ রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত মন্নুজান সুফিয়ানের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় তহবিলে নিয়োগ দেওয়া হয় শামীমা সুলতানা হৃদয়কে। ওই বছরের ৯ জুন শামীমার ‘বন্ধু’ মুহাম্মদ মেহরাব পাটওয়ারীকে একই সংস্থার সহকারী পরিচালক পদ দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি শামীমা ও মেহরাবের বিয়ে হয়।
জানা গেছে, শামীমা ও মেহরাব দম্পতির নিয়োগের কয়েক মাসের মাথায় দুজনকে কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। এরপর থেকে কেন্দ্রীয় তহবিলে না থাকলেও তারা প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর খবরদারি চালান। নেন নানা সুযোগ-সুবিধা। কেন্দ্রীয় তহবিলে না থেকেও চলতি বছরের ২৬ জুন থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত ইতালিতে ইনোভেশন টিমের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন মেহরাব। ইতালিতে প্রশিক্ষণকালে স্ত্রী শামীমা সুলতানা হৃদয়কেও নিয়ে যান তিনি। অথচ এই প্রশিক্ষণে কেন্দ্রীয় তহবিলের কোনো কর্মকর্তার যাওয়ার কথা ছিল। সে সুযোগ দেননি মেহরাব।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় তহবিলে নিয়োগ হলেও তাদের দুজনকেই শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তি দিয়ে রাখা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে তাদের নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। নেই নির্দিষ্ট ডেস্কও। নিয়মানুযায়ী, প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের জন্য ৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছেন। তবুও ভাতিজি শামীমা ও মেহরাবকে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরকেন্দ্রিক রাখা হয়েছে। মূলত ‘খবরদারি’ করার জন্যই তারা মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এই দম্পতি কখনোই নিয়মিত অফিস করেন না। যেদিন প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান অফিসে আসেন, শুধু সেদিনই তাদের দুজনকে মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। প্রতিমন্ত্রী প্রতিদিন সচিবালয়ে অফিস করেন না। তিনি মাঝেমধ্যে আসেন। এ সুযোগে শামীমা ও তার স্বামী মেহরাবও অনুপস্থিত থাকেন।
শামীমা ও মেহরাবের দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) সাইফ উদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘তারা কী কাজ করেন আমি জানি না। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় তহবিলের মহাপরিচালককে জিজ্ঞেস করতে পারেন।’
কেন্দ্রীয় তহবিলের মহাপরিচালক ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘শামীমা ও মেহরাবকে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে তারা সেখানে কী কাজ করেন, সে সম্পর্কে জানা নেই।’
বাবা-মেয়ের ইশারায় নিয়োগ ও বদলি ‘বাণিজ্য’
মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে বদলি-পদায়নের সব কাজই হয় শামীমার ইশারায়। এ কাজে তাকে পুরোপুরি সমর্থন জোগান বাবা শাহাবুদ্দিন। তাদের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরে শ্রম মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং দুদকে একাধিক অভিযোগ জমা হয়েছে।
সূত্র জানায়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক, সহকারী মহাপরিদর্শক এবং উপসহকারী মহাপরিদর্শকরা গুরুত্বপূর্ণ জেলায় পদায়নের জন্য উন্মুখ থাকেন। এ জন্য তারা শামীমা সুলতানা হৃদয়ের শরণাপন্ন হন। তিনি সিনিয়র উপমহাপরিদর্শকদের বাদ দিয়ে সহকারী মহাপরিদর্শকদের ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলা অফিসে পদায়ন করেছেন। এ জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহে শ্রম পরিদর্শক পদায়নের জন্য জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শ্রম অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (এডি) এবং উপপরিচালক (ডিডি) পদেও বদলি পদায়ন হয় তার ইচ্ছায়।
কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রণালয়ের অধীন দুই অধিদপ্তরের আউটসোর্সিং জনবল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাছাই করা এবং নতুন কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয় শামীমার ইচ্ছা অনুযায়ী। লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা নেন তিনি। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োগ করা ১১২টি এনজিওকে কাজ দেওয়ার পেছনেও শামীমার পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুদকে অভিযোগ
শামীমা সুলতানা হৃদয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং দুদকে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে পেরে প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান ভাতিজির ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অভিযোগ তদন্ত করতে মন্ত্রণালয়ের সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। তবে এখনো আলোর মুখ দেখেনি সেই তদন্ত প্রতিবেদন।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছানে এলাহীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি। একাধিকবার ফোন করলেও তিনি সাড়া দেননি। পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদক খুদেবার্তা পাঠালেও জবাব দেননি তিনি। বারবার ফোন করে পাওয়া যায়নি শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের বক্তব্য।
চাঁদার টাকায় শামীমার বিয়ের অনুষ্ঠান
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি শ্রম প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজি শামীমা সুলতানা হৃদয় ও মেহরাব পাটওয়ারী বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের বিয়ের খরচ বাবদ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিয়ের জন্য চাঁদা তোলার কাজটি করেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত সচিব) মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ। তার নির্দেশে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়গুলোকে তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। ‘এ’ ক্যাটাগরির জেলা হিসেবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের উপমহাপরিদর্শকরা দেড় কোটি টাকা দেন। ‘বি’ ক্যাটাগরি হিসেবে নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোর, কুমিল্লা, বরিশাল ও কুষ্টিয়ার উপমহাপরিদর্শকদের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে তোলা হয়। ‘সি’ ক্যাটাগরি হিসেবে মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, রংপুর, দিনাজপুর, সিলেটসহ অন্যান্য জেলার কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। সর্বমোট ৩ কোটি টাকা চাঁদা তুলে শামীমার বিয়েতে উপঢৌকন দেন কর্মকর্তারা।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে উল্টো প্রশ্ন করেন শামীমা সুলতানা হৃদয়। তিনি বলেন, ‘বিয়েতে কি ৩ কোটি টাকা খরচ হয়? এটি পুরোপুরি অসত্য অভিযোগ। আমি আমার অফিসের সব সহকর্মীকে দাওয়াত দিয়েছি। তারা বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছেন।’
বিদেশ সফরে ঘোরেন-ফেরেন তারা
গত সাড়ে ৪ বছরে প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান যতবার বিদেশ সফরে গেছেন, প্রায় সবগুলোতেই সঙ্গী হয়েছেন শামীমা সুলতানা হৃদয় ও তার বাবা এপিএস শাহাবুদ্দিন। শামীমার স্বামী মেহরাব পাটওয়ারীও প্রায় বিদেশ ভ্রমণে যান। কেন্দ্রীয় তহবিলের ওয়েবসাইটে ঢুকে তাদের বিদেশ ভ্রমণের সরকারি আদেশ (জিও) পাওয়া গেছে অন্তত ১৫টি।
ভ্রমণে না গিয়েও নেন ভাতা
প্রত্যেক সপ্তাহে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী নিজ নির্বাচনী এলাকা খুলনায় যান। সফরসঙ্গী হিসেবে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে যান তিনি। এসব সফরে বেশিরভাগ সময়ই প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে শামীমা ও তার স্বামী মেহরাব যান। আবার কোনো কোনো সময় তারা প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যান না। কিন্তু খুলনায় যাওয়া-আসার ভ্রমণ ভাতা ঠিকই তারা তুলে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে শামীমা সুলতানা হৃদয় কালবেলাকে বলেন, ‘যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি এখন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত নেই। কেন্দ্রীয় তহবিলের উপপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) হিসেবেই আছি। কেন্দ্রীয় তহবিলের সব ফাইলেই আমার স্বাক্ষর রয়েছে। হয়তো ওয়েবসাইট হালনাগাদ করা হয়নি। এ জন্য এখনো আমার নামের পাশে সংযুক্তি দেখাচ্ছে।’
তার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেন হৃদয়।
তবে মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় তহবিলে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, শামীমা সুলতানা হৃদয় ও তার স্বামী মুহাম্মদ মেহরাব পাটওয়ারী এখনো মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত আছেন।
এসব বিষয়ে মেহরাব পাটওয়ারী কালবেলাকে বলেন, ‘আমি ২০১৯ সালের ৯ জুন নিয়োগ পেয়েছি। তারপর দুই বছর কেন্দ্রীয় তহবিলে কাজ করেছি। পরে আমাকে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। বর্তমানে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে সংযুক্ত আছি। আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যই মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত রাখা হয়েছে।’
অফিসে অনুপস্থিতির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি নিয়মিত অফিস করি। অনেক সময় ৬ নম্বর ভবনে কেন্দ্রীয় তহবিলের কাজ করতে যাই। এ জন্য আমাকে আপনি মন্ত্রণালয়ে পাননি।’
মন্তব্য করুন