জাতিসংঘ আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলনে তৃতীয় বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো যেখানে আর্থিক প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবি নিয়ে সরব, ঠিক সে সময়ে পরিবর্তনের এক তত্ত্ব তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি তার ‘থ্রি জিরো বা তিন শূন্য’ তত্ত্ব বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে যত সমস্যা, সেগুলো মানবসৃষ্ট সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধানে ও সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। এর জন্য নেট কার্বন নিঃসরণ শূন্য, শূন্য দরিদ্রতা ও শূন্য বেকারত্ব—এই থ্রি জিরো ফর্মুলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
গতকাল বুধবার আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ২৯-এর ওয়ার্ল্ড লিডারস ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধন অধিবেশনে বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় ড. ইউনূস তার থ্রি জিরো তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেন।
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে নিজের আগের থ্রি জিরো তত্ত্বের সঙ্গে এবার তরুণদের যুক্ত করেছেন। পৃথিবীকে জলবায়ু বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য, শূন্য কার্বন ও শূন্য বেকারত্বের’ এই তিন শূন্য তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এ সময় অধ্যাপক ইউনূস জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতাদের কাছে এই তত্ত্বের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
ড. ইউনূস বলেন, পরিবেশ বিপর্যয় একটি বড় সমস্যা। এর থেকে উত্তরণের জন্য এখনই আমাদের সোচ্চার হতে হবে। তা না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের যে করাল থাবা, এর থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। আমি মনে করি, জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব, এটি কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নয় বা কোনো একটি জাতির একক সমস্যা নয়। তাই এর থেকে উত্তরণে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, তরুণরা সেই জীবনধারাকে পছন্দ হিসেবে বেছে নেবে। প্রত্যেক যুবক তিন শূন্যভিত্তিক ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে। এ গ্রহের নিরাপত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নতুন জীবনধারা গ্রহণ করা প্রয়োজন, যেখানে সবাই বসবাস করতে পারবে। তরুণ প্রজন্ম আমাদের এগিয়ে নেবে। আমরা যদি একসঙ্গে স্বপ্ন দেখি, তবে তা সম্ভব হবে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জলবায়ু সংকট তীব্রতর হচ্ছে এবং সে কারণে মানব সভ্যতা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মানুষ সভ্যতা বিধ্বংসী ও বিপজ্জনক বিষয়গুলো সামনে আনছে। কিন্তু আমরা একটি নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনের জন্য আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, আর্থিক ও যুব শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। তবে আমরা এমন একটা জীবনধারা বেছে নিয়েছে, যা পরিবেশ ও মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে কাজ করছে। এর থেকে আমাদের দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা এমন অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করেছি যার মূল হচ্ছে ভোগ, ভোগ এবং ভোগ। এটি শুধু বর্জ্য, বর্জ্য এবং বর্জ্য তৈরি করে। আমাদের শূন্য বর্জ্যের বিশ্ব তৈরি করতে হবে।’
প্রতি বছর জলবায়ু সম্মেলন করা উচিত নয় উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের প্রতি বছর এখানে দেখা করার দরকার নেই। প্রতি বছর আলোচনার জন্য মিটিং করা সময়সাপেক্ষ, অপচয় এবং অপমানজনক। বর্তমান পদ্ধতিটি বিশ্বের বেশিরভাগ চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলো সবচেয়ে বড় অবিচারের সম্মুখীন হয়েছে।
জলবায়ু অভিযোজন এবং প্রশমনের জন্য একটি বৃহত্তর তহবিল সুরক্ষিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
জলবায়ু সম্মেলনের তৃতীয় দিনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব। এসব বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের জলবায়ু ঝুঁকির পাশাপাশি এর থেকে পরিত্রাণের সম্ভাব্য উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন।
কার্বন নিঃসরণ কমাতে নতুন জোট ‘জি জিরো’ গঠন একই দিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে যুদ্ধ করছে তখন চারটি ছোট কার্বন-নেতিবাচক দেশ এক হয়ে গঠন করল ‘জি জিরো’ ফোরাম। গঠিত এ ফোরামে আছে ভুটান, মাদাগাস্কার, পানামা ও সুরিনাম। দেশগুলো জলবায়ু সুরক্ষার যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে একটি যৌথ ঘোষণাও দিয়েছে।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরি তোবগে, সুরিমানের প্রেসিডেন্ট চান সানতোখি, মাদাগাস্কারের প্রধানমন্ত্রী ও পানামার বিশেষ দূত এ যৌথ ঘোষণায় সই করেন।
ঐতিহাসিক এই ঘোষণা স্বাক্ষরকালে সেখানে ছিলেন সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের প্রেসিডেন্ট আশীষ গুপ্ত, এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট কেরামত উল্লাহ বিপ্লব, কোষাধ্যক্ষ মাসুম বিল্লাহসহ সাংবাদিক সংগঠনটির ছয় সদস্য। যৌথ ঘোষণা শেষে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন তারা।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, প্রধান উপদেষ্টা থ্রি জিরোর যে তত্ত্ব বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরেছেন, তা অভূতপূর্ব। এই থ্রি জিরো তত্ত্ব জলবায়ু পরিবর্তনে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এটা বাস্তবায়নে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।
জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে আজ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেশে ফেরার কথা রয়েছে। এর আগে তিনি বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি বৈঠকে অংশ নেবেন। এসব বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আশু করণীয় তুলে ধরবেন।