একটি দেশের নতুন সরকারের কর্মকাণ্ডের একশ দিনকে বলা হয় ‘হানিমুন পিরিয়ড’। এই সময়ে সরকারের গৃহীত কর্মসূচি, কর্মপরিকল্পনায় আঁচ করা যায় তারা কোন দিকে যাচ্ছে বা যাবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাস পার হয়েছে। তবে আগের শেখ হাসিনা সরকার অর্থনীতিকে যে খাদের কিনারে ফেলে গেছে, তা এখনো টেনে তুলতে পারেনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের দায় রেখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। এরপর ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই থেকে অর্থনীতিতে ব্যাপক সংস্কারের ঘোষণা দেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের চেষ্টাও চলছে। তবে কোনো কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতিতে জড়িত হাসিনা সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সর্বস্তরের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, মানুষের আশার আলো ফিকে হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন সংস্থার হালনাগাদ তথ্য বলছে, দু-একটি বাদে অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক এখনো নিম্নমুখী। সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। প্রতিদিনকার যন্ত্রণা হয়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি। এটি একদিকে মানুষের সঞ্চয়ের টুঁটি চেপে ধরছে, অন্যদিকে ক্রেতার সক্ষমতায় চিড় ধরিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। এতে সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যেও যেমন তৈরি হয়েছে স্থবিরতা, তেমনি সরকারের রাজস্ব আয়েও বিরাট ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আবার সরকারের আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ করার প্রবণতা বাড়ছে, যা কমিয়ে দিচ্ছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ পরিস্থিতিতেও চলছে ভাটা। আর বিগত সরকারের লুটপাটের সবচেয়ে বড় থাবা পড়েছিল ব্যাংক খাতে। লুটের অধিকাংশ টাকাই দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। সেই পাচারের অর্থ দেশে ফেরাতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে নতুন সরকার। তবে সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে মনে করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরকার চিত্র উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি তো আরও করুণ। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে আপাতত খুব বেশি সুখবরের আভাস মিলছে না। তবে নানা সংকটের মধ্যেও আশার খবর হচ্ছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ছে। ফলে রিজার্ভ আপাতত স্থিতিশীল রয়েছে। বিদেশি ঋণ পাওয়ারও বেশকিছু আশ্বাস পাওয়া গেছে। ডলারের বাজারও স্থিতিশীল রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বিগত সরকারের অর্থ পাচার, দুর্নীতি, অনিয়ম আর লুটপাট করে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে সে পরিস্থিতি উত্তরণের চেষ্টা করছে। তবে কাজটা খুব সহজ নয়। এর জন্য সময়ও অনেক বেশি লাগবে। তিনি বলেন, এই সরকার দায়িত্ব নিয়ে আর্থিক খাতের সংস্কারে বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। সেগুলো কাজ করছে। সেটার ফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আর্থিক খাতের এই বিশ্লেষক বলেন, অক্টোবর মাস (বাংলায় কার্তিক মাস) অর্থনীতির জন্য সবসময়ই সবচেয়ে খারাপ সময়। এ সময় অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক খারাপ হলেও আগামী ডিসেম্বরের পর থেকে সেগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করবে।
বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তার অভিমত, দেশে এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীলতা আসেনি। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখনো আসছেন না। আর দেশীয় বিনিয়োগকারীদের অধিকাংশই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ অবস্থায় সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সেইসঙ্গে রাজস্ব আদায়েও মনোযোগ বাড়াতে হবে।
ড. মঈনুল ইসলাম আরও বলেন, ব্যাংকিং খাতে সংস্কার উদ্যোগ চলছে। ফলে এখন দেশ থেকে টাকা পাচার কমবে। তবে পাচারের অর্থ ফেরাতে সরকারকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আর রপ্তানি আয় বাড়াতে পণ্য বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। এ বিষয়গুলোতে সরকার কার্যকর উদ্যোগ নিলে দেশের অর্থনীতি দ্রুত সময়েই ঘুরে দাঁড়াবে।
ঘাটতি রাজস্বেই যত দুশ্চিন্তা: সরকারের অর্থায়নের প্রধান উৎস হলো রাজস্ব খাত। এখানকার বড় ঘাটতি থেকেই অর্থনীতির সব সমস্যার সূত্রপাত। বিগত সরকারের সবচেয়ে বড় সমালোচনার জায়গা ছিল রাজস্ব আয়ের ঘাটতি। বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা এবং গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার আগে এ বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেছিলেন। তবে দায়িত্ব নিয়ে তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) সংস্কারের ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। আগের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবরে) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি তৈরি হয়েছে ৩০ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ১১২ কোটি টাকা। এ সময়ে প্রকৃতপক্ষে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা।
লাগামহীন মূল্যস্ফীতি: কয়েক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির তাপে পুড়ছে দেশের মানুষ। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের শ্রমিক এবং দিনমজুরদের এ বিষয়ে ক্ষোভ ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে। সে জায়গা থেকেই তারা সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের উচ্ছ্বাস ছিল অন্য রকম। কিন্তু তিন মাস পর এসে তাদের সেই উচ্ছ্বাস মিলিয়ে গেছে।
নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন দফায় বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার। এতেও মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানা যাচ্ছে না। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা বাস্তবতায় এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি তিন অঙ্কে ঘোরাফেরা করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন বলছে, গত অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর খাদ্যমূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে ঠেকেছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, আগের মাস অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে ঠেকেছিল। কিন্তু মাসের ব্যবধানে অক্টোবরে প্রায় এক শতাংশ বেড়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ শতাংশের কাছাকাছি, যা গত একযুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, অক্টোবরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি আবারও ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মূলত গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরের বন্যার প্রভাবে অক্টোবরে দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বলে জানান তিনি। গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ে সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতি জোর করে কমিয়ে রাখা হতো। কিন্তু আগস্ট থেকে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি প্রকাশ করা হচ্ছে। যার কারণে সঠিক তথ্যই উঠে আসছে। তিনি বলেন, পণ্যের দাম কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সময় লাগবে। সাত বছর ধরে বেড়ে চলা মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করেই কমানো যাবে না। মানুষকে ধৈর্য ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কম আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডলার রেট বর্তমানে স্থিতিশীল আছে। সুতরাং মূল্যস্ফীতি কমতে বাধ্য।
আমদানিতে গতি নেই: বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর অর্থনীতির দেশে দীর্ঘদিন ধরে আমদানিতে চলছে কড়াকড়ি ও নানা বিধি-নিষেধ। ফলে চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার আমদানি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছর (জুলাই-সেপ্টেম্বরে) আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খোলার হার কমেছে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। একই সময় এলসি নিষ্পত্তির হার কমেছে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এ সময়ে সবচেয়ে বেশি কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি। তবে আলোচ্য সময়ে খাদ্যপণ্য আমদানি বেড়েছে।
বিনিয়োগে স্থবিরতা: বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপে একদিকে কমছে আমদানি, অন্যদিকে বাড়ছে ব্যাংক ঋণের সুদহার। ফলে নতুন বিনিয়োগে যেতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও কমে যাচ্ছে। চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ সূচকটি আরও কমে ৯ দশমিক ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। সেইসঙ্গে লক্ষ্যণীয়ভাবে কমছে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হার। বিবিএসের তথ্যানুসারে, গত জুন প্রান্তিক শেষে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, যা আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রবৃদ্ধির হার আড়াই গুণ কমে যাওয়ায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সার্বিক প্রবৃদ্ধিতেও প্রভাব পড়েছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোয় উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য মোটেও স্বস্তিকর নয়। এটা বিনিয়োগ কমে যাওয়াকেই ইঙ্গিত করে। কারণ, দেশের মোট বিনিয়োগের অধিকাংশই আসে ব্যাংকিং খাতের ঋণ থেকে। এ ঋণ বিনিয়োগ কমে গেলে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান কমে যাবে। ফলে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের যে লক্ষ্য রয়েছে, তাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হবে।
একই বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। তবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে শিল্প খাতে এমন কোনো ব্যাপক পরিবর্তন আনা উচিত হবে না, যা এ খাতকে আরও ভঙ্গুর করে ফেলে। অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের কথা মাথায় রেখে শিল্প খাতকে সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।
শঙ্কামুক্ত নয় রপ্তানি আয়: দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস রপ্তানি খাত। এখন পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হলেও তা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না। জুলাই-আগস্ট মাসে উৎপাদন খাতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা কাটিয়ে দেশের পণ্য রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে। এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, গত অক্টোবরে রপ্তানি আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ বেড়েছে। সেইসঙ্গে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ১ হাজার ৫৮৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ বেশি। তবে দুদিক থেকেই লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে রয়েছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গাজীপুর ও আশুলিয়ার কারখানাগুলোয় বেশ কিছুদিন অসন্তোষ চলার পর শ্রমিকরা কাজে ফিরেছেন গত মাসে। তা ছাড়া শীত মৌসুম ও ক্রিসমাস উৎসবের জন্য পোশাক জাহাজীকরণ হচ্ছে। সে জন্য রপ্তানির গতি বেড়েছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আগামী গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কম এসেছে। সেইসঙ্গে গ্যাস-সংকটের কারণে এখন পোশাক কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো সময়মতো ঋণপত্র খুলতে পারছে না। তাই আগামী দিনে পোশাক রপ্তানি কতটা বৃদ্ধি পাবে, সে বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, তা নির্ভর করছে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ ও ব্যাংক খাতের সহায়তার ওপর।
ঋণ করে দেশ পরিচালনার পথেই সরকার: হাসিনা সরকারের সময়ে রাজস্ব ঘাটতির বিপরীতে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সরকারের ব্যয় অত্যধিক বেড়েছে। ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিয়েই সে ঘাটতি পূরণ করেছে সরকার। আগের সরকারের ধারাবাহিকতায় ঋণ নিয়ে দেশ পরিচালনার দিকেই ঝুঁকছে নতুন সরকার। গতানুগতিকতার বাইরে যেতে পারছে না এই সরকার। যদিও অর্থ উপদেষ্টা এবং গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং ড. আহসান এইচ মনসুর দুজনেই ব্যাংক থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নেওয়ার বিরোধিতা করে সরকারকে আয় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। বর্তমান সরকারে তারা দুজন দায়িত্ব নেওয়ার পরও ব্যাংক এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়েই সরকারের ব্যয় মেটাতে হচ্ছে।
তবে আশার দিক হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ না নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকেই ঋণ নিচ্ছে সরকার। উল্টো বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে।
ব্যাংকে গ্রাহকের আস্থা তলানিতে: বিগত সরকারের সময়ে অর্থনীতি ধ্বংসের মূল আয়োজন ছিল ব্যাংকিং খাতে লুটপাট ও অর্থ পাচারকে কেন্দ্র করে। একটিমাত্র শিল্প গ্রুপ এস আলমের হাতে তুলে দিয়েছিল সাত থেকে আটটি ব্যাংক। সেইসঙ্গে সরকারে প্রভাব বিস্তারকারী সালমান এফ রহমানসহ আরও কয়েকজনের নিয়ন্ত্রণে ছিল আরও চার থেকে পাঁচটি ব্যাংক। এসব ব্যাংকে জমা রাখা গ্রাহকের অধিকাংশ টাকাই পাচার হয়ে গেছে। এসব ব্যাংকে ঘুরে ঘুরেও গ্রাহকরা টাকা তুলতে পারছেন না। এতে ব্যাংক খাতের প্রতি গ্রাহকের আস্থা তলানিতে নেমে এসেছে।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গ্রাহকের আমানতের সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়া হবে। এজন্য গ্রাহকদের আরও কিছুটা সময় ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সংকটে পড়া ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেইসঙ্গে এসব ব্যাংকে প্রয়োজন অনুযায়ী, গ্যারান্টির ভিত্তিতে তারল্য সহায়তাও দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেও এসব ব্যাংকের পরিস্থিতি উত্তরণ হচ্ছে না।
খেলাপি ঋণের উদ্বেগ কমছে না: বিগত সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির অভাব ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতার কারণে ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান খেলাপি ঋণের চিত্র অর্থনীতিতে ভয়ংকর রকমের উদ্বেগ তৈরি করেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। কেবল টাকার অঙ্কে নয়, বেড়েছে শতকরা হিসাবেও। চলতি বছর জুনে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ সময় খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের এই হার দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে ব্যবসায়ীদের কোনো ধরনের অনৈতিক সুবিধা না দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন আহসান এইচ মনসুর। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে এই গভর্নরও ব্যবসায়ীদের কিছু ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর মধ্যে ঋণপত্র বা এলসি মার্জিন ছাড়াই নিত্যপণ্য আমদানি করা এবং যেসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান খাদ্য, নিত্যপণ্য ও সার আমদানি করে, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সীমা থাকবে না। অর্থাৎ তারা তাদের প্রয়োজন মতো ঋণ নিতে পারবে।
এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আগের সরকারের সময়ে দেশে ঋণখেলাপিদের তিরস্কারের পরিবর্তে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এটা ব্যাংক খাতের জন্য অশনিসংকেত। বর্তমান সরকার এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
বাড়ছে রেমিট্যান্স, স্থিতিশীল রয়েছে রিজার্ভ: নতুন সরকারের সবচেয়ে আশার দিক হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এর ফলে রিজার্ভেরও বর্তমানে স্থিতিশীল রয়েছে। সেইসঙ্গে ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। বলা হয়ে থাকে, যে দেশে যত বেশি রিজার্ভ, সেই দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত বেশি টেকসই হয়। যে কোনো সংকট মোকাবিলায় সক্ষমতাও বেশি থাকে। বাংলাদেশের রিজার্ভ পরিস্থিতিও একেবারে মন্দ ছিল না। তবে বিগত সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ভুল নীতি’র কারণে তা কমে উদ্বেগজনক অবস্থায় নেমে যায়। সেই জায়গা থেকে নতুন সরকারের কয়েকটি উদ্যোগে স্থিতিশীল রয়েছে রিজার্ভ। আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) অনুযায়ী, গত ৬ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০ বিলিয়নের ওপরে।
পাচারের অর্থ ফেরাতে সরকারের উদ্যোগ: শেখ হাসিনার শাসনামলে সাবেক প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ব্যাংকিং খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। এর মধ্যে এস আলমই পাচার করেছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। নজিরবিহীনভাবে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বর্তমান সরকার নানা ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব, যদিও তা অনেক কঠিন ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যেসব দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে, ওই সব দেশের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে দেশগুলোর সহযোগিতার মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ। পাচারের অর্থ উদ্ধারে দুদক এবং বিএফআইইউকে ঢেলে সাজানোরও পরামর্শ দেন তিনি।