গণতন্ত্র উত্তরণের পথে যারা দীর্ঘ সময় আন্দোলনে ছিল, বিএনপিসহ সমমনা সেই রাজনৈতিক দলগুলো খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচনী রূপরেখা আশা করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসেও এটি ঘোষিত না হওয়ায় দিন যত যাচ্ছে, এই দাবি ততই জোরালো হচ্ছে। ‘যৌক্তিক’ সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে আসা বিএনপি এ বিষয়ে আর বেশিদিন ধৈর্য না ধরার চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। দলটির তরফ থেকে এরই মধ্যে স্পষ্ট করেই নির্বাচনী রোডম্যাপ চাওয়া হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে রোডম্যাপ দেওয়া না হলে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে সোচ্চার হবে দলটি। বিএনপি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার ও নির্বাচনী প্রস্তুতি একসঙ্গে চলতে পারে। বিএনপির সঙ্গে সমমনা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের স্পষ্ট ঘোষণা চায়। কারণ, সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। তাই নির্বাচন নিয়ে সরকার কী ভাবছে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তা স্পষ্ট নয়। সরকারের কেউ কেউ ইঙ্গিত দিচ্ছেন, আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। আবার কেউ বলছেন, প্রয়োজনীয় সব সংস্কার শেষে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন ইস্যুতে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে বিএনপি। দলটি বলছে, সংস্কার একটি দীর্ঘ ও চলমান প্রক্রিয়া। রাষ্ট্র সংস্কারে সরকার যে দশ কমিশন করেছে, সেগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে কবে নাগাদ সংস্কার কার্যক্রম শেষ হবে, সেটাও স্পষ্ট নয়। তা ছাড়া কোন সংস্কারগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা হবে, সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়নি, সেটিও। অবশ্য বিএনপির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে সরকারকে নির্বাচন কমিশন (ইসি), প্রশাসন এবং বিচার বিভাগকে প্রাধান্য দিয়ে সংস্কার কার্যক্রম চালানোর জন্য বলা হয়েছে। দলটির নেতারা বলছেন, সব সংস্কার কার্যক্রম সমাপ্ত করতে গেলে এই সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতে হবে, যেটা সম্ভব নয়।
বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বয়কট করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন তাদের মূল টার্গেট হচ্ছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। এই দাবিতে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তারা এরই মধ্যে সোচ্চার হতে শুরু করেছেন। দলটির নেতারা এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য দিচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র কাঠামোর কী কী সংস্কার করতে চায় এবং সেটা করতে কতদিন লাগবে, কোনো ছলচাতুরি ছাড়াই তা স্পষ্ট করে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছেন তারা। বিএনপি নেতারা বলছেন, জাতিকে অন্ধকারে রেখে সরকার যা খুশি তাই করবে, জনগণ সেটা মেনে নেবে না। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন গত ১৬ বছরের বিনা ভোটের সরকারকে মানেনি, এখন এই সরকারকেও দীর্ঘদিন মানবে না।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, নির্বাচন সম্পর্কিত সংস্কার কার্যক্রম, নির্বাচনী রোডম্যাপ ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে পারে। নির্বাচনমুখী সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে ভোটার তালিকা প্রণয়নসহ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। এ জন্য নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা দেওয়া জরুরি। তাতে করে জনগণ বুঝতে পারবে, তারা একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে মানুষ আরও বুঝতে পারবে, নির্বাচিত একটি রাজনৈতিক সরকারের অধীনে তারা কবে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সব সংস্কার কার্যক্রম সমাপ্ত করতে গেলে এই সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতে হবে, সেটা তো সম্ভব নয়। এমনটা হলে নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে। আমরা মনে করি, সরকার নির্বাচনের দিকেই এগোচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, তারা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছেন। একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কিছু সংস্কার কার্যক্রম করতে হবে। তবে নির্বাচন কবে হবে, এ ব্যাপারে সরকারের একটি রোডম্যাপ দেওয়া উচিত।
বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, দেশে বর্তমানে কিছু কিছু সংকট রয়েছে। যেমন অর্থনৈতিক সংকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি। নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলে এগুলো কেটে যাবে; বিনিয়োগ আসবে, বাজার স্থিতিশীল হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি ঘটবে।
জামায়াতে ইসলামীও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এ ক্ষেত্রে সংস্কারকেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে নির্বাচনই একমাত্র সমাধান বলে ভাবছে দলটি। বিএনপির শরিকরাও দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা চায়। তারা নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।
জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না কালবেলাকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে একটি নির্বাচন আয়োজন করা। এ জন্য কিছু সংস্কার প্রয়োজন, যাতে সমান লেবেল প্লেয়িং ফিল্ডে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। তাই নির্বাচনমুখী সংস্কারকে এখন প্রাধান্য দিতে হবে। রাষ্ট্রের সব সংস্কার করা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তা ছাড়া মানুষও এখন ভোট দিতে উদগ্রীব। তাই সরকারের উচিত দ্রুত একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, সেটা ঠিকই আছে। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এ জন্য নির্বাচন কমিশন গঠন ও প্রশাসন তৈরি করতে হবে। এটা করতে দীর্ঘ সময় লাগার কথা নয়।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, তিন মাস হলো অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এখন অবিলম্বে তাদের নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। দেশবাসীর প্রত্যাশা, সরকার নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। কারণ, বিগত তিনটি নির্বাচনে ভোটাধিকার বঞ্চিত জনগণ এখন ভোট দিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি তাদের সমমনা জোট ও দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা দীর্ঘ সময় রাজপথে ছিল, তাদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে বিএনপির প্রতিশ্রুতি আছে। এ কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যাতে নির্বাচনের মাঠে নির্বিঘ্নে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে পারে, এরই মধ্যে সে উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে কয়েকজন জোট নেতাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জোটের ছয় নেতাকে এই চিঠি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জোট নেতাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় সহযোগিতা করতে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে দলের সভাপতি/সাধারণ সম্পাদককেও চিঠি দিয়েছে বিএনপি। তবে মাত্র ছয়জনকে চিঠি দেওয়ায় জোটের অন্য শরিকদের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। কারণ, অনেকে মনে করছেন, ছয়জনকে চিঠি দেওয়া মানে তাদের ওই ছয়টি আসনে প্রাক-মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে পরে জানানো হয়, এই চিঠি কোনো দলীয় মনোনয়ন নয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে শরিকদের ক্ষোভ প্রশমনে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিটি জেলায় দলের সভাপতি/সাধারণ সম্পাদককে অনুরূপ নির্দেশনার চিঠি দেওয়া হচ্ছে, যাতে শরিক দলের নেতারা স্বাচ্ছন্দ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে পারে। এ জন্য তাদের সহযোগিতা করতে বিএনপির তৃণমূলের নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রের চিঠিতে।
বিএনপিও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে গত দেড় মাস ধরে জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতারা দেশব্যাপী প্রচারণা চালাচ্ছেন। গ্রামগঞ্জে, হাটে-বাজারে গিয়ে ‘ধানের শীষ’ সংবলিত লিফলেট বিতরণ করছেন। এ সময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনী প্রতীকের শুভেচ্ছা বিনিময়ও করছেন তারা। এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে।