২০০৯ সাল থেকে গত ১৬ বছরে ১৮ হাজার ৭৬ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক বিবেচনায় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সব লাইসেন্সধারীকে নিজ নিজ জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কাছে বৈধ অস্ত্র জমা দিতে নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে অস্ত্র জমা দেননি ৯৯৭ লাইসেন্সধারী; তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দলঘনিষ্ঠ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে তাদের বেশিরভাগেরই খোঁজ নেই। তাদের অস্ত্রগুলো জমা না পড়ায় জননিরাপত্তা আশঙ্কাজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নির্ধারিত সময়ে যারা অস্ত্র জমা দেননি, আইন অনুযায়ী তাদের লাইসেন্স বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ তাদের কাছে থাকা অস্ত্রগুলো এখন অবৈধ। লাইসেন্স বাতিল হওয়া এসব অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ডিসিরাও লাইসেন্স বাতিল করে অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে মামলার পক্ষে মত দেন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশের পক্ষ থেকে এখনো লাইসেন্স বাতিল হওয়া কোনা অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়নি। প্রায় হাজারখানেক অস্ত্র এবং অস্ত্রধারীরা এখন কোথায়, সে তথ্যও নেই পুলিশের কাছে। তথ্য না পাওয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল ও উদ্ধার নিয়ে কোনো হালনাগাদ তথ্য দিতে পারছে না।
লাইসেন্স বাতিল হওয়া ৯৯৭ অস্ত্রের মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকার ৫৯১টি। বাকিগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার ৪০টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ৭০টি, ঢাকা রেঞ্জে ১৯৪টি, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৫টি, রাজশাহী রেঞ্জে ৫৯টি, খুলনা রেঞ্জে ৬টি, বরিশাল রেঞ্জে ৭টি এবং সিলেট রেঞ্জের ১৬টি অস্ত্র।
ঢাকার জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ কালবেলাকে বলেন, তার আওতাভুক্ত এলাকায় যারা অস্ত্র জমা দেননি; তাদের সবার লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মামলা করার বিষয়টি পুলিশের দায়িত্ব।
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে সেই দায়িত্ব পালনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি! এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা বা পরিকল্পনার কথা জানা যায়নি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কোনো কর্মকর্তার কাছে। অবশ্য ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (অ্যাডিশনাল ডিআইজি পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আহম্মদ মুঈদ কালবেলাকে বলেছেন, লাইসেন্সধারীদের কেউ কেউ চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। আবার কেউ কেউ পলাতক আছেন। অনেকে তাদের পূর্বের ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন। আমরা সবগুলো বিষয় খতিয়ে দেখছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী অবৈধ অস্ত্রধারীদের নামে মামলা হবে।
এদিকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র জমা না পড়ায় জননিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ ও অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক কালবেলাকে বলেন, অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে আসলে এই মুহূর্তে পুলিশ বাহিনী খুব বেশি একটা ব্যবস্থা নিতে পারবে না। তবে এখনো অস্ত্র জমা না দেওয়ায় নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত হওয়ার একটি আশঙ্কা আছে। অস্ত্র উদ্ধারের ক্ষেত্রে সরকার যৌথ বাহিনীর অভিযানের ব্যবস্থা করেছে। জিরো টলারেন্স মানসিকতা নিয়ে যদি শক্তিশালীভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে এসব অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা ছিল গত ৩ সেপ্টেম্বর। ওই সময়ের মধ্যে যারা অস্ত্র জমা দেননি তাদের নামে অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে আইনি ব্যবস্থা অর্থাৎ মামলা করার নির্দেশ দিয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক-৪ শাখা। কিন্তু লাইসেন্স বাতিল ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে মামলা করছেন না ডিসিরা। আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও জোরালো কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে না।
৩০ সেপ্টেম্বর পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য প্রদত্ত সব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স (কর্মরত সামরিক অসামরিক কর্মকর্তা ব্যতিত) স্থগিত করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র থানায় জমা দানের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। যারা ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে থানায় অস্ত্র জমা দেননি তাদের আগ্নেয়াস্ত্র অবৈধ হিসেবে গণ্য হয়েছে। এমতাবস্থায় এসব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দ্য আর্মস অ্যাক্ট ১৮৭৮ এবং আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬-এর ১৯ (চ) ও ২০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাতিলপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে আগামী ১৪ অক্টোবরের মধ্যে বাতিলকৃত লাইসেন্সের বিবরণ এবং অবৈধ লাইসেন্সধারীদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন কড়া নির্দেশের পরও এ বিষয়ে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। ওই চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছিল, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি), বিভাগীয় কমিশনার, সকল পুলিশ কমিশনার, সব রেঞ্জ ডিআইজি, সব পুলিশ সুপার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিগত সরকারের আমলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সুপারিশ ছাড়া সহজে অস্ত্রের লাইসেন্স মিলত না। অস্ত্রের লাইসেন্সের ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করত তার দপ্তরের লোকজন। বলতে গেলে আওয়ামী লীগের শাসনামলের পুরো সময়ে দলীয় বিবেচনায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রের লাইসেন্সে দেওয়া হতো। আওয়ামী লীগের প্রভাব বেশি থাকা জেলাগুলোতেই গত ১৬ বছরে সবচেয়ে বেশি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার দপ্তরের লোকজনের তদবিরেই এসব অস্ত্র দেওয়া হয়েছে। অস্ত্রধারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ‘সন্ত্রাসীরাও’ রয়েছেন। এখন আশঙ্কা হচ্ছে এসব অস্ত্র দিয়ে তারা নাশকতা চালাতে পারে।
মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদস্থ একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দেওয়া এসব অস্ত্র এখনো জমা হচ্ছে না। অবৈধ হয়ে যাওয়া এসব অস্ত্র আর জমা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। ফলে অবৈধ অস্ত্রগুলো দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাণ্ডব চালাতে পারে আশঙ্কা করছেন কর্মকর্তারাও। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও মনে করছেন দ্রুত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা জরুরি।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীর কাছে লাইসেন্সওয়ালা এবং বিনা লাইসেন্সের ভারী অস্ত্রশস্ত্রের শেষ নেই। সেটা বিগত আন্দোলনে দেখা গেছে। দেশবাসী তখন দেখেছে, রাস্তায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ কীভাবে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জনগণের ওপর হামলা করেছে। আমরা চাই এসব অস্ত্র উদ্ধারে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান, লাইসেন্সওয়ালা অস্ত্র যেগুলো জমা না দেওয়ায় ইতোমধ্যে অবৈধ হয়ে গেছে সেগুলোসহ বিনা লাইসেন্সের অবৈধ অস্ত্র যেগুলো আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীর কাছে রয়েছে, সেগুলো উদ্ধারে অবিলম্বে চিরুনি অভিযান শুরু করা হোক।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও অবৈধ অস্ত্র নিয়ে তার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের দোসররা তাদের কালো টাকা ও বেআইনি অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে। গত সোমবার ঢাকার সাভারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ব্যাংক টাউন এলাকায় গুলিতে নিহত সাভারের প্রথম শহীদ শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি এমন আশঙ্কার কথা জানান।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চলছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে।