বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া নিয়ে বিগত সরকার ২০১৪ সালে পাস করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী। সেই সংশোধনী বাতিলের রায় দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহাসহ সাত বিচারপতির বেঞ্চ। ২০১৭ সালের ১ আগস্ট ওই রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তার লেখা রায়ে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেন। এস কে সিনহার এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থি আইনজীবীরা। কেউ কেউ তখনকার প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার পর কৌশলে বিচারপতি এস কে সিনহাকে ছুটিতে পাঠিয়ে দেয় তৎকালীন সরকার। ছুটি নিয়ে কানাডা যাওয়ার পথে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে রাষ্ট্রপতি বরাবর তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন। ২০১৭ সালের নভেম্বরে তার পদত্যাগপত্র বঙ্গভবনে পৌঁছায়। পরে পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ; কিন্তু যেসব পর্যবেক্ষণের কারণে সাবেক প্রধান বিচারপতি তার পদ হারিয়েছিলেন, সেসব পর্যবেক্ষণ বহাল রয়েছে। ওই রায় রিভিউয়ের আবেদনে পর্যবেক্ষণগুলো বাতিল চাওয়া হয়েছিল। তার পক্ষেও নানা যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল; কিন্তু গতকাল সরকারের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ওইসব যুক্তি আদালতে উপস্থাপন করেননি। ফলে আপিল বিভাগ পর্যবেক্ষণগুলোর ব্যাপারে কিছুই বলেননি।
রাজনীতিতে আমিত্বের কড়া সমালোচনা করেন এস কে সিনহা: প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আমি ও আমিত্ব’ সংস্কৃতির সমালোচনা করেন। তিনি রায়ে বলেন, ‘আমাদের সংবিধানের ভিত্তি হচ্ছে, ‘আমরা জনগণ’ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। জাতীয় সংসদ সংবিধানের পরিপন্থি কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না এবং কোনো আইন সংবিধানসম্মত কি না, তা বিচার করার অধিকার সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকেই দিয়েছে।’
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রায়ে উল্লেখ করেন, ‘১৯৭১ সালে আমরা যে অলঙ্ঘনীয় ঐক্য গড়েছিলাম, তা শত্রুরা নস্যাৎ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আজ আমরা একটি মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে বাস করি। অথচ আজ ঔদ্ধত্য এবং অজ্ঞতাকে আমরা প্রশ্রয় দিয়ে চলছি। কোনো একজন ব্যক্তি দ্বারা কোনো একটি দেশ বা জাতি তৈরি হয়নি। আমরা যদি সত্যিই জাতির পিতার স্বপ্নে সোনার বাংলায় বাঁচতে চাই, তাহলে এই আমিত্বর আসক্তি এবং আত্মঘাতী উচ্চাভিলাস থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে হবে। এই আমিত্ব হলো কেবল এক ব্যক্তি বা একজন মানুষ সবকিছুই করতে পারেন এমন ভাবনা।’
রায় প্রদানকারী আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির মধ্যে পাঁচজন বিচারপতি সাবেক প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করার পরও আলাদা করে নিজেরা পর্যবেক্ষণ দেন। তবে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা প্রধান বিচারপতির রায়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করে তার বাইরে আর কিছু লেখেননি।
এস কে সিনহা পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নগর-পরিকল্পনার দিকে তাকাই, তাহলে দেখি যেই ব্যক্তি তাদের নগরের পরিকল্পনা করেছেন, তাকেই তারা স্বীকৃতি দিয়েছে। দাসপ্রথা বিলুপ্তির জন্য আব্রাহাম লিংকনের স্ত্রী মেরি টড স্বীকৃতি পেয়েছেন। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আরও অনেকে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাদের মধ্যে চারজন জেনারেলও রয়েছেন; কিন্তু আমাদের দেশে একটি রোগ আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। আর সেই রোগের নাম ‘অদূরদর্শী রাজনৈতিকীকরণ’। এটা একটা ভাইরাস এবং দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সংস্কৃতিকে তা এমন বিস্তৃতভাবে সংক্রমিত করেছে যে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এমন একটি ভবিষ্যৎ দেখতে বা কল্পনা করতেও পারছেন না যে ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পুরো জাতি, কোনো একজন ব্যক্তি নন।’
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, “এই বাজে রোগের কারণে নীতিনির্ধারকরা সবকিছু ব্যক্তিকরণ করে ফেলেছেন। তারা তাদের ক্ষুদ্র এবং সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একটি ভুয়া ও ‘মেকি গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর এটা তারা লজ্জাজনকভাবে আমাদের সংবিধানের অন্যায্য সুবিধা নিয়ে করেছেন। অথচ ১৯৭১ সালে আমাদের শহীদেরা রক্ত দিয়ে এ সংবিধান লিখেছিলেন। আমাদের অবশ্যই এই নোংরা ‘আমাদের লোক’ মতবাদ পরিহার করতে হবে। পরিত্যাগ করতে হবে এই আত্মঘাতী ‘আমি একাই সব’ দৃষ্টিভঙ্গি। দলীয় আনুগত্য বা অর্থবিত্ত নয়, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠান তৈরিতে শুধু মেধার বিবেচনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।”
পর্যবেক্ষণে এস কে সিনহা বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষভাবে এবং কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে না হতে পারে, তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে একটি গ্রহণযোগ্য সংসদও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সে কারণে আমাদের নির্বাচনপ্রক্রিয়া এবং সংসদ শিশু অবস্থায় রয়ে গেছে। জনগণ এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা অর্পণ করতে পারছে না। এ দুটি প্রতিষ্ঠান যদি জনগণের আস্থা এবং শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ থেকে বিরত থাকে, তাহলে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভাবে বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের দিয়ে সংসদ গঠিত হতে পারে না, বরং তা সংসদের নিজের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণকে ব্যাহত করতে পারে।’
রায়ে বলা হয়, ‘সংসদ যদি যথেষ্ট পরিপক্বতা অর্জন না করে, তাহলে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ করার ক্ষমতা সংসদের কাছে ন্যস্ত করা হবে একটি আত্মঘাতী উদ্যোগ। সংসদের কাছে বিচার বিভাগের জবাবদিহি করা উচিত নয়; বরং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে জাতীয় নির্বাচনে তাদের প্রার্থী বাছাইয়ে সতর্ক হওয়া। যেসব দেশে বিচারপতিদের সংসদীয় অভিশংসনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেসব দেশের গণতন্ত্র আমাদের তুলনায় বয়ঃপ্রাপ্ত হলেও সেখানে ওই ব্যবস্থা কার্যকরভাবে প্রয়োগ সম্ভব হয়নি।’
৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, ‘এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের বেদনাহত এবং অসংগতভাবে তাদের অধিকারকে শৃঙ্খলিত করেছে। তাই সংসদের কোনো ইস্যুতেই তারা দলীয় অবস্থানের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নিতে পারেন না। সংবিধানের ৯৫(২)গ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো আইন না করা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে নির্বাহী বিভাগকে একটি বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। আর ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় নির্বাহী বিভাগের প্রভাব পড়বে।’
তিনি লিখেছেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই, ৭০ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য হলো সরকারের স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। দলের সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। সংসদ সদস্যদের যদি সন্দেহের চোখেই দেখা হয়, তাহলে তাদের কী করে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের মতো দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজে ন্যস্ত করা যায়। তাই এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যের চেতনা হলো সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা তাদের মনোনীত করা দলের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখবেন। আসলে তারা তাদের দলের উচ্চপর্যায়ের হাতে জিম্মি। তাই ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগ যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছেন, তার মধ্যে আমরা কোনো বৈকল্য দেখি না। সংসদের হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হলে বিচারকেরা দলের হাইকমান্ডের অনুকম্পানির্ভর হয়ে পড়বেন।’