বেসরকারি চিকিৎসা শিক্ষা খাত গত ১৫ বছর রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে। মেডিকেল কলেজ অনুমোদন ও পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের অধিকাংশই মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামীপন্থি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী। এতে অভিভাবকদের বিপুল অর্থ প্রভাবশালীদের পকেটে গেলেও মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
অপর্যাপ্ত জমি, অবকাঠামো ঘাটতি, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক সংকট, শ্রেণিকক্ষ স্বল্পতা, লাইব্রেরিতে আসন ও মিউজিয়ামে সরঞ্জাম সংকট, হাসপাতালে অপর্যাপ্ত শয্যাসংখ্যাসহ নানা শর্ত উপেক্ষিত ছিল প্রভাবশালীদের মেডিকেল কলেজে।
অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চালানো হয় এসব চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষা উপযোগিতার ঘাটতি পূরণে বারবার নির্দেশনা জারির পরও ক্ষমতা-ঘনিষ্ঠ হওয়ায় শর্ত পূরণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। উল্টো প্রভাব বিস্তার করে সব নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে।
২০২২ সালের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইনে ৫০ আসনের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য মেট্রোপলিটন এলাকায় কলেজের নামে ন্যূনতম দুই একর এবং মেট্রোপলিটনের বাইরে ন্যূনতম চার একর জমি থাকতে হবে। তবে মেট্রোপলিটন এলাকায় আইন পাসের আগে একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বেসরকারি মেডিকেল কলেজের নামে ন্যূনতম এক একর জমি থাকতে হবে। এই জমি কলেজের নামে নিরঙ্কুশ, নিষ্কণ্টক, অখণ্ড ও দায়মুক্ত হতে হবে। একাডেমিক ও হাসপাতাল মিলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসহ সর্বনিম্ন ২ লাখ বর্গফুট ফ্লোর স্পেস থাকতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শন, ডিনস কমিটি এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের প্রতিবেদনে রাজধানীর ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ, এমএইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজ, পপুলার মেডিকেল কলেজ, গ্রিনলাইফ মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ, সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ, ইস্ট-ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ, মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর ভূঁইয়া মেডিকেল কলেজ এবং গাজীপুরের ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়টি উঠে এসেছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে বারবার সময় বেঁধে দিলেও ক্ষমতার প্রভাবে শর্ত পূরণ করেনি।
গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেশের ৭৩ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের তথ্য প্রকাশ করা হয়। সেখানে প্রভাবশালীদের মেডিকেল কলেজের শিক্ষক, জনবলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ নেই।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিশেষজ্ঞ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আফজালুর রহমান কালবেলাকে বলেন, যত্রতত্র মেডিকেল কলেজের বেশিরভাগ মানসম্মত নয়। বেশিরভাগই ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। ব্যবসায়িক স্বার্থে মেডিকেল কলেজ ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। রাজনৈতিক স্বার্থে এগুলো ব্যবহার করতে দেওয়া ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, আদৌ দেশে এত মেডিকেল কলেজ দরকার আছে কি না, সেটা ভেবে দেখা দরকার। প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে দেখতে পারি দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে কত মেডিকেল কলেজ এ দেশে থাকা দরকার। এত মেডিকেল কলেজ প্রয়োজন না হলে, সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে।
সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ: নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজধানীর মালিবাগের ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ পরিচালনার প্রধান শর্তই লঙ্ঘন করেছে। কলেজের ওই ভনের ১০ দশমিক ৬৪ কাঠা জমি নুরুল হাসান ফারুক, সামসুল হাসান ও মাহবুব হাসানের নামে এবং ৩৪ কাঠা জমি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ডা. সিরাজুল ইসলামের নামে রয়েছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা আইন অনুযায়ী একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রধান শর্ত পূরণে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানটি। কলেজের নিজস্ব নামে আরও ১৫২ শতাংশ জমি নামজারি করতে হবে।
২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে ১০০ শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন পায়। আইন অনুযায়ী হাসপাতালে প্রায় ৩০ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) আইন অনুযায়ী, শিক্ষক সংকট, ক্লাসরুম সংকট, লাইব্রেরিতে অপর্যাপ্ত আসন সংখ্যা, মিউজিয়ামে সরঞ্জাম ঘাটতিসহ নানা শর্ত উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চলছে। কয়েকটি বিভাগে আরও ৬৭ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া; লাইব্রেরিতে আরও ১২৫টি আসন বৃদ্ধি; ক্লাসরুমের সংখ্যা ও মিউজিয়ামে সরঞ্জাম বৃদ্ধি—এসব শর্ত পূরণে কয়েক দফা সময় বেঁধে দেয় বিএমডিসি। কিন্তু স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজের প্রভাবে শর্ত না মেনেই কলেজটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত স্বাচিপের মহাসচিব ছিলেন তিনি। ওই সময় প্রভাব খাটিয়ে তিনি বিএমডিসি স্ট্যান্ডিং রিকগনিশন কমিটির চেয়ারম্যান পদ বাগিয়ে নেন। একটি বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হয়েও তিনি অন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে বিএমডিসির মৌলিক নির্দেশনাবলি গুরুত্ব না দিয়ে বিভিন্ন কলেজ কর্তৃপক্ষকে হয়রানি করতেন এবং নিজের মর্জিমাফিক পরিদর্শন প্রতিবেদন দাখিল করতেন বলে একাধিক অধ্যক্ষ জানিয়েছেন। এ ছাড়া এই কলেজের নামে বিদেশি শিক্ষার্থীর আসনে দেশি শিক্ষার্থী ভর্তি, মেধাতালিকায় নেই—এমন শিক্ষার্থী নাম নিবন্ধনের জন্য প্রেরণ, নিরাপত্তা তহবিলের টাকা তুলে নেওয়া, সাবেক অধ্যক্ষের স্বাক্ষর জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কলেজ পরিদর্শক দপ্তর গত বছরের ৬ জুন সুনির্দিষ্টভাবে ১৩টি বিষয়ে জানতে চেয়ে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. এমএ আজিজের কাছে একটি চিঠি দেয়। কিন্তু মেডিকেল কর্তৃপক্ষ সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি।
২০২০ সালের ২৫ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত টাস্কফোর্স এবং র্যাব অভিযান চালিয়ে রাজধানীর মালিবাগে সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে হাসপাতালটির ল্যাব থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট এবং চারটি অপারেশন থিয়েটার থেকে বিপুল পরিমাণ সার্জিক্যাল সামগ্রী উদ্ধার করে। নানা অনিয়মের অভিযোগে হাসপাতালটিকে তখন ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ওই সময় এ হাসপাতালে যত মাইক্রোবায়োলজি রিপোর্ট তৈরি হয়েছে, সবই ভুয়া রিপোর্ট বলেও দাবি করেছে র্যাব।
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ: ধানমন্ডিতে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজের ৮৬ দশমিক ৮৫ কাঠা জমি কলেজের নামে রেজিস্ট্রেশন বলে জানানো হয় ঢাবির কলেজ পরিদর্শন ও ডিনস কমিটির এক প্রতিবেদনে। কিন্তু জমি নিবন্ধনের সার্টিফাইড কপি জমা দেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ। জমি বা ফ্লোর স্পেস কোনোটিই কলেজ ও হাসপাতালের নেই। নিয়ম অনুযায়ী আরও ৭০ শতাংশ জমি কলেজের নামে ক্রয় করে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে দলিলের কপি জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয় ওই প্রতিবেদনে। কিন্তু কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ার খান নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই প্রতি শিক্ষাবর্ষে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করে নেন। কলেজ ও হাসপাতালে ফ্লোর স্পেস সংকট রয়েছে। যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক সংকট, ক্লাসরুম সংকট, লাইব্রেরিতে অপর্যাপ্ত আসন সংখ্যা, বই সংকট, মিউজিয়ামে সরঞ্জাম ঘাটতিসহ নানা নিয়মের ব্যত্যয় রয়েছে এই চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আনোয়ার খান সবকিছু থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন রাজনৈতিক প্রভাব ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হিসেবে।
এমএইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজ: তেজগাঁওয়ের এমএইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটি আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য এম মকবুল হোসেনের। মেডিকেল কলেজে ৯৫ শতাংশ জমি এবং কলেজ ও হাসপাতালের জন্য ২ লাখ ৫৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষার্থী অনুপাতে হাসপাতালে ১৫০টি শয্যা ঘাটতি, ৫৬ শতাংশ শয্যা অকুপেন্সি ঘাটতিসহ প্রায় সব বিভাগে শিক্ষক, ল্যাব, শ্রেণিকক্ষের সরঞ্জাম, লাইব্রেরির আসন এবং সার্ভিস রুলের ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন শর্ত পূরণ না করেও প্রতি শিক্ষাবর্ষে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী কলেজটিতে আবশ্যকীয় শর্তাবলি পূরণের নির্দেশনা থাকলেও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সবকিছু বৈধ করে নিয়েছেন প্রয়াত এ সংসদ সদস্য ও তার পরিবার।
পপুলার মেডিকেল কলেজ: ধানমন্ডির পপুলার মেডিকেল কলেজকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও আধুনিক মেডিকেল কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ঢাকার মোহাম্মদপুরে কেনা ১১২ দশমিক ৬৩ কাঠার অতিরিক্ত আরও ৭ দশমিক ৩৭ কাঠা জমি কলেজের নামে কিনে দলিলের সার্টিফাইড কপি জমা দিতে বলা হয় ঢাবির ডিনস কমিটির প্রতিবেদনে। কলেজের নামে জমি কেনার কথা বলা হলেও মোহাম্মদপুর কাটাসুর মৌজায় বিভিন্ন দাগে ৯টি দলিলে ১১২ দশমিক ৬৩ কাঠা জমি দলিলে গ্রহীতা হিসেবে কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমানের নাম রয়েছে। এতে নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে। কলেজের বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক স্বল্পতাও রয়েছে। কলেজ ও হাসপাতালে ১ লাখ ৮ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস ঘাটতি রয়েছে। এসব নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা কর্ণপাত না করেই প্রতি শিক্ষাবর্ষে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং কলেজের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন আওয়ামীপন্থি ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান। দলীয় প্রভাবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতির পদও বাগিয়ে নেন।
ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ: গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মুবিন খান। তিনি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও। তার কলেজে প্রতি শিক্ষাবর্ষে ১৩০ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও ১ লাখ ৪৯ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস সংকট এবং হাসপাতালে ৯৮ হাজার ফ্লোর স্পেস ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষার্থী অনুপাতে হাসপাতালে শয্যা ঘাটতি, শয্যা অকুপেন্সি ঘাটতিসহ প্রায় সব বিভাগে শিক্ষক সংকট, ল্যাব, শ্রেণিকক্ষের সরঞ্জাম, লাইব্রেরির আসন এবং সার্ভিস রুলের ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া মেডিকেল কলেজে কোন অর্গানোগ্রাম নেই বলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে করোনাকালে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টিউশন ফি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে ‘বাড়াবাড়ি’ করলে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা আইনের কোনো ব্যত্যয় করেনি।
গ্রিনলাইফ মেডিকেল কলেজ: রাজধানীর গ্রিন রোডের গ্রিনলাইফ মেডিকেল কলেজে বর্তমান অবস্থানে ৪৮ শতাংশ জমি ও ভবন ২০১৬ এবং ২০২১ সালের মধ্যে কলেজের নামে রেজিস্ট্রেশন করে দলিলের সার্টিফাইড কপি জমা দিতে বলা হয় ঢাবি কলেজ পরিদর্শন ও ডিনস কমিটির প্রতিবেদনে। কলেজের পাশে ক্রয়কৃত আরও ১০ কাঠা জামির দলিলের সার্টিফাইড কপি জমা দিতে বলা হয়। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সার্টিফাইড কপি জমা দেওয়ার শর্ত পূরণ করেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ। কলেজ ও হাসপাতালের জন্য ১ লাখ ২৯ হাজার ৬২১ বর্গফুট ফ্লোর স্পেস ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতালে শয্যা অকুপেন্সি ঘাটতিসহ প্রায় সব বিভাগে শিক্ষক সংকট রয়েছে।
এনাম মেডিকেল কলেজ: স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন নির্দেশনা উপেক্ষা করে সাভারে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান প্রতিষ্ঠিত এনাম মেডিকেল কলেজ। কলেজের বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে শিক্ষক সংকট। হাসপাতালে ৬১ দশমিক ৮ শতাংশ শয্যা অকুপেন্সি বৃদ্ধির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া টিউটরিয়াল রুম বৃদ্ধি, ক্লাসরুম ও মিউজিয়ামের পরিবর্তন এবং লাইব্রেরিতে বই ও আসন বৃদ্ধি করতে বলা হয়। কিন্তু মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটিয়ে অতীতে ওই শর্তগুলো পূরণ করেননি ডা. এনামুল হক।
বিক্রমপুর ভূঁইয়া মেডিকেল কলেজ: মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ধামলা গ্রামে ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে বিক্রমপুর ভূঁইয়া মেডিকেল কলেজ। শর্ত পূরণ না করেই মেডিকেল কলেজের অনুমোদন পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ডা. বদিউজ্জামান ভূঁইয়া ডাবলু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিদর্শন ও ডিনস কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই মেডিকেল কলেজে ৯৩ দশমিক ১৩ শতাংশ জমি ঘাটতি রয়েছে। কলেজ ও হাসপাতালের জন্য প্রায় ১ লাখ বর্গফুট ফ্লোর স্পেস ঘাটতি রয়েছে। অধিকাংশ বিভাগে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। কোনো কোনো বিভাগের নিজস্ব শিক্ষক নেই। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব হোস্টেল ঘাটতি, ক্লাসরুম সংকট, লেকচার গ্যালারি ঘাটতি রয়েছে। শর্ত পূরণে কলেজ কর্তৃপক্ষ বারবার ব্যর্থ হলেও ক্ষমতা ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কলেজের নবায়ন বাতিল অথবা কোনো প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ: ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ মন্ত্রণালয়ের শর্ত পূরণ না করেই একাডেমিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। ঢাবির কলেজ পরিদর্শন ও ডিনস কমিটির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কলেজের নামে কোনো জমি বা ভবন না থাকায় কলেজের বর্তমান অবস্থানের ২ বিঘা জায়গা ও ভবন কলেজের নামে সাবকবলা দলিলমূলে রেজিস্ট্রি এবং কলেজের বর্তমান অবস্থানের পাশাপাশি আরও ৪ বিঘা জমি ক্রয় অথবা অন্যত্র জমি ক্রয় করে দলিলের সার্টিফাইড কপি জমা দেওয়ার শর্ত এখনো পূরণ করা হয়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে শিক্ষক সংকট, ভবন সংকট, হাসপাতালে শয্যা অকুপেন্সি সংকটসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণের নির্দেশ দেওয়া আছে। এসব শর্ত পূরণে বারবার ব্যর্থ হয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
ইস্ট-ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ: ঢাকার তুরাগের ইস্ট-ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজের পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নেই বলে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। মেডিকেল কলেজে ৫০ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস ঘাটতি এবং হাসপাতালে ৭০ শতাংশ শয্যা অকুপেন্সি বৃদ্ধি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরিতে অপর্যাপ্ত আসন সংখ্যা, মিউজিয়ামে সরঞ্জাম ঘাটতিসহ নানা শর্ত উপেক্ষা করে চলছে মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম।
গা-ঢাকা দিয়েছেন মালিকরা!: অভিযোগের বিষয়ে জানতে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন খান, এমএইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান আহসানুল ইসলাম টিটু এবং ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের এমডি ও বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) সভাপতি এম এ মুবিন খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাদের ব্যক্তিগত মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এসব প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করা হলে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানান, তারা কেউ দেশে নেই।
তবে অভিযোগের বিষয়ে গ্রিনলাইফ মেডিকেল কলেজের এমডি ডা. মো. মঈনুল আহসান বলেছেন, কলেজ ও হাসপাতালের স্পেস ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে। কলেজ পরিদর্শন প্রতিবেদনে যে ঘাটতির কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর কিছুই এখন আর অপূর্ণ থাকার কথা নয়।
যা বললেন স্বাস্থ্য শিক্ষার জিডি: দেশের চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নানা অসংগতির বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন কালবেলাকে বলেন, বেশকিছু মেডিকেল কলেজ মানসম্মত নয়। একেকটার একেক সমস্যা। কোনোটার অবস্থা একেবারে ভয়াবহ। বন্ধ করে দেওয়ার মতো। দায়িত্ব গ্রহণের পর দেখেছি ছয়টি মেডিকেল কলেজের অবস্থা খুবই খারাপ। সেই ছয়টি মেডিকেল কলেজ নিয়ে সভা করেছি। কয়েকটির অবস্থা আরেকটু ভালো। তুলনামূলকভাবে একটু ভালো বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকে কীভাবে সচল কর যায়, সেই উপায় নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। মুশকিল হলো একটি মেডিকেল কলেজের নির্দেশ আছে পরিদর্শনের। সেখানে পরিদর্শন রিপোর্ট অনেক পুরোনো। ওই মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা ওই পরিদর্শন রিপোর্টের পর কাজ করেছে। এখন পরিদর্শন টিম গঠন করতে গেলে বিএমডিসি প্রতিনিধি প্রয়োজন হয়। এই মুহূর্তে বিএমডিসি নেই। বিএমডিসি গঠন না হওয়া পর্যন্ত পরিদর্শনও করা যাচ্ছে না। আমরা আশা করছি, শিগগির বিএমডিসি গঠন করা হবে। এরপর পরিদর্শন রিপোর্ট ধরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।