আলাউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩২ এএম
আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৪৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পুলিশে ঊর্ধ্বতনদের প্রতি অধস্তনদের আস্থাহীনতা দূর হয়েছে

পুলিশে ঊর্ধ্বতনদের প্রতি অধস্তনদের আস্থাহীনতা দূর হয়েছে

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে গা ঢাকা দেন ১৫ বছর ধরে সরকার ও প্রশাসনে হাসিনার দুঃশাসনের সহযাত্রী হিসেবে নিযুক্ত কর্মকর্তারাও। তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তৎকালীন কমিশনার মো. হাবিবুর রহমানও। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রবল জনরোষের মুখে রাজধানীসহ সারা দেশে পুলিশের কাঠামো রীতিমতো ভেঙে পড়ে। এমন এক দুঃসময়ে গত ৭ আগস্ট ডিএমপির ৩৭তম কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান বিসিএস ১৭ ব্যাচের কর্মকর্তা মো. মাইনুল হাসান এনডিসি। এর পর থেকে পুলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহৎ এই ইউনিটে শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন তিনি। দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাস পর ডিএমপির সার্বিক পরিস্থিতি, বর্তমান চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কালবেলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত কথা বলেছেন কমিশনার মাইনুল হাসান।

সাক্ষাৎকারে ডিএমপির এই শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ৫ আগস্টের পর পুলিশ ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে ঢেলে সাজানো হয়েছে এবং সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তায় সব থানার কার্যক্রম পুরোদমে চালুর পর পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা ও নির্ভরশীলতা বেড়েছে। জামিন পাওয়া জঙ্গি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া রাজধানীতে অসহনীয় যানজট নিরসনে ট্রাফিক ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা অবহিত করে ডিএমপি কমিশনার আরও জানান, পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থাকে আনা হচ্ছে রিমোট কন্ট্রোলড সেমি অটোমেশন সিস্টেমের আওতায়।

দায়িত্ব গ্রহণের সময়ের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে মাইনুল হাসান বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পুলিশ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। এর মধ্যে বিভিন্ন দাবিতে কর্মবিরতিতে যান পুলিশের বড় একটি অংশ। ওই অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে আমি কাজ শুরু করি। যার যার ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পুলিশের নিহত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। কর্মবিরতিতে থাকা সদস্যদের কাউন্সেলিং করে, সাপোর্ট দিয়ে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করি। কিছু দাবি তাৎক্ষণিক মেনে নিয়ে পুলিশ বাহিনীকে সংস্কারসহ বাকি দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি অধস্তনদের যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছিল, তা দূর করা গেছে। ধীরে ধীরে পুলিশে আস্থা ফিরে এসেছে। বড় ধরনের বিপর্যয়ের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুলিশকে কাজে ফেরানো হয়েছে।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আন্দোলনে ডিএমপির ১৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত ও ৫০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। ডিএমপির ২২টি থানা ও ট্রাফিক বক্সসহ ২০০ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতা ও সমর্থনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানসহ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় থানার কার্যক্রম দ্রুত শুরু হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া ও ভাঙচুর করা থানাগুলো মেরামত ও সংস্কার করা হয়েছে। তবে এখনো যাত্রাবাড়ী ও পল্টন থানার অবকাঠামোগত সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি বলেও জানান তিনি।

মাইনুল হাসান আরও বলেন, বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া ১ হাজার ১০০ অস্ত্রের মধ্যে প্রায় ৭০০টি এখনো উদ্ধার করা যায়নি। লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। ধারণা করছি, এসব অস্ত্র বিভিন্নজনের কাছে আছে। যাদের কাছে আছে তাদের প্রতি অনুরোধ—গোপনে হলেও অস্ত্রগুলো আমাদের কাছে জমা দিন। কারণ চলমান অভিযানে এসব অস্ত্রসহ কেউ ধরা পড়লে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হবে।

পুলিশের মনোবল ফেরাতে বাহিনীতে সংস্কার এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি পূরণের ব্যাপারে ডিএমপি কমিশনার বলেন, পুলিশ সদস্যদের দাবির মধ্যে ছিল সারা দেশের সব ইউনিটের ইউনিফর্ম এক হবে। ডিএমপি বা অন্য ইউনিটের ইউনিফর্মের রং আলাদা হবে না। এই দাবি মেনে নিয়ে সারা দেশের সব ইউনিটের সব পুলিশ সদস্যের জন্য অভিন্ন রঙের ইউনিফর্ম তৈরির কাজ চলছে।

৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে পুলিশের মধ্যেও ভীতি ছিল জানিয়ে মাইনুল হাসান বলেন, এই সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সাধারণ মানুষও পুলিশের অভাব অনুভব করেছে। কিন্তু পুলিশ মাঠে ফেরার পরও সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বেড়েছে। এ ব্যাপারে গৃহীত পদক্ষেপ জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ছিনতাই, চুরি ও ছিঁচকে ছিনতাইয়ের নেপথ্যে অনেক কারণ আছে। বেকারত্ব, ভাসমান লোক, মাদকাসক্তি বড় ধরনের সামাজিক সমস্যা। এসব সমস্যা নিরসন করতে হবে। চুরি ছিনতাই রোধে পুলিশের প্যাট্রলিং বাড়ানো হয়েছে। এলাকাভিত্তিক বিট পুলিশিং, কমিউনিটি পুলিশিংকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ। এতে মানুষ অনেকটা নিরাপদ বোধ করছেন। এর পরও অপরাধ ঘটে গেলে মানুষ আইনের সহায়তা নিতে পারেন। থানায় মামলা করলে পুলিশ তদন্ত করে অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেবে। কমিশনার আরও বলেন, নগরীর অধিকাংশ মানুষ শান্তিপ্রিয়। দুষ্টচক্রে জড়িতদের সংখ্যা কম। সাধারণ মানুষ পুলিশকে সহযোগিতা করলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।

রাজধানীর যানজট ভয়াবহ রূপ ধারণ করায় অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নগরবাসী—এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, যানজট নিরসনে ঢাকা মহানগর পুলিশ আগেও অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সেগুলো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। এখন আমরা ট্রাফিক সিগন্যালগুলো রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের জন্য সেমি অটোমেশন পদ্ধতি চালু করছি। এতে ট্রাফিকের জনবল কম লাগবে। সিগন্যালে জনবল কম লাগলে তারা অন্য কাজে সময় দিতে পারবেন।

এখনো কর্মস্থলে অনুপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, বিভাগীয় ব্যবস্থা হিসেবে অনুপস্থিত পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। আরও যারা অনুপস্থিত রয়েছেন; তাদের বিষয়েও বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সরকার পতনের পর গত দুই মাসে একাধিক জঙ্গি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজার মেয়াদ শেষ করে কিংবা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এর জের ধরে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। দেশে নতুন করেও জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিতে পারে বলেও চিন্তিত অনেকে। তবে ডিএমপি কমিশনার এ বিষয়ে বলেন, জামিন যে কোনো ব্যক্তির নাগরিক ও আইনি অধিকার। যেসব জঙ্গি বা শীর্ষ সন্ত্রাসী আদালত থেকে মুক্তি পেয়েছে তাদের সিসিটিসি ইউনিট ও এটিইউর মাধ্যমে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। হিযবুত তাহরীরসহ নিষিদ্ধ সংগঠন যারা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে তাদের বিষয়েও পুলিশ সতর্ক রয়েছে। এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। জঙ্গি দমনে সাধারণ মানুষ আমাদের সহযোগিতা করছে।

সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যারা বৈধ অস্ত্র জমা দেননি, তাদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে মাইনুল হাসান বলেন, অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের অনেকেই পলাতক ও আত্মগোপনে রয়েছে। তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হচ্ছে এবং তাদের অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পিছিয়ে থেকেও ইনিংস ঘোষণা বাংলাদেশের, ব্যাটিং বিপর্যয়ে ক্যারিবীয়রা

চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের বৈঠক

হাসপাতালের মতো জায়গায় হামলা নিন্দনীয় : ড্যাব

ক্যাম্পাসে ছাত্রদের সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রশিবিরের উদ্বেগ প্রকাশ 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর অনাকাঙ্ক্ষিত : জামায়াত

চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের বিবৃতি

৯ বছর পর খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌদি রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

আন্দোলনে নিহত রিকশাচালকের মরদেহ ১১১ দিন পর কবর থেকে উত্তোলন

চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার নিয়ে যা বললেন প্রেস সচিব

গণগ্রেপ্তারের পরও ইসলামাবাদের প্রবেশপথ ইমরান সমর্থকদের দখলে

১০

ছাত্রসমাজের ভূমিকা শক্তিশালী করে গড়ে তোলার আহ্বান

১১

কোটালিপাড়ায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদলের মতবিনিময়

১২

জাতীয় পর্যায়ে শুরু হলো সমতায় তারুণ্য প্রকল্প

১৩

রিয়ালের গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের আগে ইনজুরিতে ভিনি

১৪

ভাতিজাকে সভাপতি বানিয়ে টাকা আত্মসাৎ কলেজ অধ্যক্ষের

১৫

সেন্টমার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলে নতুন সিদ্ধান্ত

১৬

ডেঙ্গুতে আরও ২ জনের মৃত্যু

১৭

রাস্তায় নয়, ন্যায্য দাবি নিয়ে আমার কাছে এসো : শিক্ষা উপদেষ্টা  

১৮

চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে শাহবাগে বিক্ষোভ

১৯

সোহরাওয়ার্দীর পর কবি নজরুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা

২০
X