চরম সংকটে দেশের অধিকাংশ ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অনিয়ম, লুটপাট আর ঋণ কেলেঙ্কারির জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ ঋণই এখন খেলাপি। এমনকি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের ৩৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জুনভিত্তিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তবে খাতসংশ্লিষ্ট এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা আসল চিত্র নয়। প্রকৃত খেলাপি আরও বেশি, যা এ খাতের জন্য অশনিসংকেত। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৫টি। ২০২৪ সালের জুলাই শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। এসব ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশই খেলাপি। ২০২৩ সালের জুন শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ২৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম করেছেন, পুরো খাতই এখন তার জের টানছে। পিকে হালদারের মালিকানা আছে বা ছিল, এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যে কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা কী হওয়া দরকার সে বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ নুরুল আমিন কালবেলাকে বলেন, বর্তমানে কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থার উন্নতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। ব্যাংকগুলোর ওপর যে ধরনের নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও সে ধরনের নীতি প্রয়োগ করা দরকার। অনিয়মে জড়িতদের সরিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বোর্ড পুনর্গঠন ও নীতি সহায়তার মাধ্যমে তুলে আনা।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম দেখাতে পারেনি। তারা নতুন নতুন পণ্য নিয়ে আসতে পারেনি। শেয়ারবাজারেও তাদের অবদান নেই বললেই চলে। এ জন্যই একটা বড় ব্যাংকের বড় শাখা দেশের অর্থনীতিতে যে ধরনের অবদান রাখছে, পুরো খাত মিলেও সেই অবদান রাখতে পারছে না। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বিস্তারেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজর দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৮ দশমিক ২২ শতাংশ। খাত বিবেচনায় এত পরিমাণ আদায় অযোগ্য ঋণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতকেই ঝুঁকিতে ফেলেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। জানা যায়, ২০২০ সালের জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ছিল ৮ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। আর গত বছরের জুনে এই খেলাপির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে পিপলস লিজিং, বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, সিভিসি ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি, হজ ফাইন্যান্স, ফনিক্স ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, বে লিজিং, উত্তরা ফাইন্যান্স এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।