রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার, নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা, প্রশাসন নিরপেক্ষকরণ, নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার করা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে যথেষ্ট অস্পষ্টতা ও ধীরগতি রয়েছে বলে মনে করে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি। এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে কি না, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন দলটির নেতারা। এমন অবস্থায় দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা তারা বুঝতে চাইছেন। এজন্য দেশের চলমান পরিস্থিতি, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন।
গত মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বৈঠকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দুই মাস পার হতে চলল। কিন্তু এখনো নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। তা ছাড়া তারা আগামী দিনের রাষ্ট্র বিনির্মাণে কী চিন্তা করছেন, কখন নির্বাচন দেবেন, রাষ্ট্র সংস্কার কীভাবে করবেন, আগে রাষ্ট্রের সব সংস্কার, নাকি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন হবে, রাজনৈতিক দলগুলোকে যথেষ্ট স্পেস দিতে চান কি না—এসব নিয়ে জনগণের মনে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে। এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারকে জাতির সামনে পরিষ্কার করতে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসের কার্যক্রমের ভালো-মন্দ দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেন, প্রশাসনে কয়েক ধাপে রদবদল করা হলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীরা এখনো রয়ে গেছে। তা ছাড়া রদবদলে ঘুরে-ফিরে তাদেরই আনা হচ্ছে। এতে করে উল্টো আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন হচ্ছে। এই প্রশাসন দিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
বৈঠকে কেউ কেউ বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে নিজেরাই বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা বলছেন। একবার বলছে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে দেড় বছর, একবার বলছে দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন হবে। আবার একবার বলছে দেড় বছরের মধ্যে সব সংস্কার কাজ শেষ করা হবে, তারপর নির্বাচন দেওয়া হবে। তাদের মেয়াদকাল নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সরকারের একটা বক্তব্যের সঙ্গে আরেকটা বক্তব্য মিলছে না।
বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ এ বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশনের গঠন কার্যক্রম আলোচনায় তোলেন দু-একজন নেতা। তারা বলেন, ছয়টি কমিশনের ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরুর কথা ছিল। ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা কাজ করে রিপোর্ট দেবে। সরকার এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে। কিন্তু এখন আবার সুর পাল্টে বলছে, আগে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে তারা আলোচনায় বসবেন। সরকারের কথাবার্তা ও আচরণের মধ্যে মিল থাকছে না। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন কোনো কোনো নেতা।
গত ১১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে ছয়টি কমিশন তথা নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠনের কথা জানান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারকে সহযোগিতা করতে তাদের গঠিত এই ছয় কমিশনের সঙ্গে মিল রেখে ছয়টি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত করা ছয়টি কমিটির মধ্যে সংবিধান পুনর্গঠন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে। সদস্য আছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন, অধ্যাপক ড. মাহফুজুল হক সুপন ও অধ্যাপক ড. নাজমু জামান ভূঁইয়া ইমন।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারকে। সদস্য হলেন অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি মোহাম্মদ রইস উদ্দিন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, বিচারক ইকতেদার হোসেন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম।
পুলিশ বিভাগ সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম। সদস্য হচ্ছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জহিরুল ইসলাম, সাবেক আইজিপি আবদুল কাইউম, সাবেক ডিআইজি খোদা বক্স ও ডিআইজি খান সাঈদ হাসান।
প্রশাসন সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে। সদস্য হচ্ছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আবদুল হালিম, ইসমাইল জবিউল্লাহ ও সাবেক সচিব মনিরুজ্জামান খান। দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি শরফুদ্দিন চাকলাদার ও বিচারপতি এএফএম আবদুর রহমানের নাম আলোচনায় রয়েছে। সদস্য হচ্ছেন ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল ও সাবেক সচিব আবদুর রশিদ।
নির্বাচন কমিশনবিষয়ক সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানকে। সদস্য হচ্ছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক আমলা ইসমাইল জবিউল্লাহ ও সাবেক সচিব আবদুর রশিদ।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনিক সংস্কারকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকেই গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন তারা। নেতারা মনে করেন, রাষ্ট্র সংস্কারে বিএনপির ৩১ দফা রূপরেখার মধ্যেই সবকিছু আছে। সেই আলোকে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রস্তাব দেওয়ার ব্যাপারে সবাই মতামত দেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এরই মধ্যে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। আশা করছি, তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন। বিএনপিও এই সংস্কার কার্যক্রমে সুনির্দিষ্টভাবে সুপারিশমালা তুলে ধরবে।’
আগামী শনিবার থেকে আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির একটি ছোট টিম অংশগ্রহণ করবে। সেখানে দু-একজন বিশেষজ্ঞও থাকতে পারেন। তবে টিমে কারা কারা থাকবেন, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যার সহযোগী ছিলেন এবং ইতোমধ্যে যারা হত্যা মামলার আসামি—শেখ হাসিনা সরকারের এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট আওয়ামী লীগের নেতারা এখনো গ্রেপ্তার না হওয়ায় বৈঠকে প্রশ্ন তুলে আলোচনা করেন বিএনপির কয়েকজন সদস্য। এ ছাড়া এখনো বিএনপি নেতাদের মামলা প্রত্যাহার না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, তারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখতে পেয়েছেন, পতিত শেখ হাসিনা সরকারের এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, মন্ত্রী-সংসদ সদস্য বিদেশে পালিয়ে গেছেন। তাদের কাউকে কাউকে ভারতের বিভিন্ন মাজার ও পার্কেও দেখা গেছে। বিএনপির নেতারা মনে করেন, হত্যা মামলার পরও এসব আসামি কীভাবে পালালেন, কারা তাদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে, এসব বিষয়ে জনমনে যথেষ্ট প্রশ্ন ও উদ্বেগ আছে।
আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে পাঠানোয় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে। বৈঠকে নেতারা বলেন, মাহমুদুর রহমানকে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার কারাগারে পাঠিয়েছিল। তিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনামলে অনেক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এখন আবারও তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অথচ স্বৈরাচার সরকারের দুর্নীতিবাজ এমপি-মন্ত্রী ও আওয়ামী সন্ত্রাসী ক্যাডারদের ধরছে না প্রশাসন। তাদের আইনের আওতায় আনার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। অবিলম্বে মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে বৈঠকে।