দেশে মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তার সরকার কোনো সমালোচনায় বিরক্ত হয় না। বরং গঠনমূলক সমালোচনাকে আমন্ত্রণ জানায় অন্তর্বর্তী সরকার।
নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বুধবার বিকেলে একটি হোটেলে বিশ্বের অর্ধডজনেরও বেশি শীর্ষ মানবাধিকার সংস্থার সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।
এ সাক্ষাতে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিপ্লব এবং গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনা সরকারের শাসন আমলে চালানো নৃশংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার ও জবাবদিহিতা নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন আমলে প্রায় ৩ হাজারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আরও তদন্তের ওপর গুরুত্বারোপ করেন মানবাধিকার সংগঠনের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া তারা নিরাপত্তা সেক্টর সংস্কার, সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং অধিকতর তদন্ত, একনায়কতন্ত্রের সময় বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের রাখা ডিটেনশন কেন্দ্রগুলোতে অবাধ প্রবেশাধিকার এবং জবাবদিহি নিশ্চিতের আহ্বান জানান।
বৈঠকে ৯ সদস্যের প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দেন রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ডও এ বৈঠকে যোগ দেন।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন আমলে কীভাবে নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার খর্ব হতো এবং অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কী কী করছে, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেন ড. ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তার সরকার পুলিশসহ প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারে কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। তার সরকার যে কোনো সমালোচনাকে স্বাগত জানায় এবং অন্তর্বর্তী প্রশাসন মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
সংস্কারের জন্য বাংলাদেশকে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার দেবে বিশ্বব্যাংক:
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া নানা সংস্কারের পাশে থাকবে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি জানিয়েছে, অর্থনৈতিক সংস্কার, ডিজিটালাইজেশন, তারল্য, জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে সংস্কারের জন্য ৩.৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়া হবে।
নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বুধবার দুপুরে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে অর্থ সহায়তা দেবেন বলে জানান। বৈঠকে ড. ইউনূস তার নেওয়া সংস্কার কাজের জন্য বিশ্বব্যাংকের আরও সহায়তা চান।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
অধ্যাপক ইউনূসের দীর্ঘদিনের বন্ধু বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা। তিনি বলেন, অন্তত দুই বিলিয়ন ডলার নতুন ঋণ দেওয়া হবে এবং বিদ্যমান ঋণ কর্মসূচি থেকে আরও দেড় বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়া হবে।
চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ‘নতুন অধ্যায়’ খুলতে চান ড. ইউনূস:
চীনকে বাংলাদেশের জনগণের ‘পুরোনো বন্ধু’ আখ্যা দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ‘নতুন একটি অধ্যায়’ খুলতে চাই। এর মাধ্যমে অতীতের মতো সব উন্নয়ন কাজের অংশীদার হবে চীন। বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর বাংলাদেশের সঙ্গে তার দেশের সম্পর্ক আরও গভীরে নিয়ে যেতে চায় বলে জানান।
নিউইয়র্কে স্থানীয় সময় বুধবার বিকেলে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়। এ সময় তারা এসব কথা বলেন।
ড. ইউনূস বলেন, চীনা সৌর কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে আরও বড় আকারে বিনিয়োগ করতে পারে, যা অনেক ধনী দেশের কাছে পছন্দের বাজারে প্রবেশাধিকার ভোগ করে। তিনি অন্য চীনা নির্মাতাদেরও বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থাপন করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশে সোলার প্যানেল প্রকল্পে বিনিয়োগকে গুরুত্বসহকারে দেখছে চীন। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে গভীরভাবে কাজ করতে চায় দেশটি। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর বলেন, চীন বাংলাদেশে সোলার প্যানেলে বিনিয়োগ এবং ঢাকার সঙ্গে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করতে চায়। এ সময় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে অভিনন্দন জানান চীনা মন্ত্রী।
ইউনূস-শেহবাজ বৈঠক:
সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার আগ্রহ প্রকাশ
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা ‘সার্ক’কে পুনরুজ্জীবিত করতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সরকারপ্রধান ঐকমত্য পোষণ করেছেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ‘নতুন অধ্যায়’ উন্মোচন করা উচিত বলে মত দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ।
স্থানীয় সময় বুধবার সকালে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বৈঠকে মিলিত হন। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে তাদের মধ্যে এ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়।
এ সময় দুই দেশের সরকারপ্রধান দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার শীর্ষ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করা দরকার, এ ক্ষেত্রে একটি ভালো উপায় হতে পারে পাকিস্তানের সমর্থন।’ উত্তরে শেহবাজ শরিফ তার সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে ধাপে ধাপে তারা এগিয়ে যাবেন।
শরিফ বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উচিত তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ‘নতুন পৃষ্ঠা’ উন্মোচন করা। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা খুবই জরুরি।’
শেহবাজ শরিফ বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও চামড়া খাতে তার দেশের বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেন। অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস দুই দেশের মধ্যে ‘যুব কর্মসূচি’ বিনিময়ের প্রস্তাব দেন।
এ ছাড়া দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আলোচনা নবায়ন এবং দুই দেশের মধ্যে যৌথ কমিশন ফের সক্রিয় করার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। আলোচনাকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
ড. ইউনূসকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের শুভেচ্ছা:
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সাক্ষাৎ করেন তারা।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টাকে শুভেচ্ছা জানান। এ সময় উভয় নেতা কুশল বিনিময় করেন।
জ্বালানি ও বাণিজ্য সহযোগিতা জোরদারে ইউনূস-ওলি আলোচনা:
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে জ্বালানি, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারের বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
স্থানীয় সময় বুধবার বিকেলে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) অধিবেশনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উভয় নেতা এ সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেন। একই সঙ্গে তারা বাংলাদেশে নেপালি শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির কথা স্বীকার করেন।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে আমি আনন্দিত। এ সময়ে জ্বালানি ও ট্রানজিট সহযোগিতা, পর্যটন, সাংস্কৃতিক বিনিময়, শিক্ষাগত সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় ফোরামে সহযোগিতার ওপর নজর দেওয়া হয়।’
বৈঠকের ফল সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, অধ্যাপক ইউনূস ও কে পি শর্মা ওলির মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে তারা ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি ও বাণিজ্য সহযোগিতা কীভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করেন।
প্রেস সচিব বলেন, নেপালের জলবিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত রয়েছে এবং তারা দু-তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জলবিদ্যুৎ রপ্তানিতে সক্ষম হবে।