বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে চাকরিজীবন শুরু আবু বকর সিদ্দিকের। পর্যায়ক্রমে হন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক। তার এই পদোন্নতির পেছনেও রয়েছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। সহকর্মীদের কাছে আবু বকরের পরিচিতি ‘জিনের বাদশা’ নামে। ঘুষের বিনিময়ে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দিতেন তিনি। তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিতেন ডলার ও ইউরোতে। গত জানুয়ারিতে অবসরে যাওয়া এই ব্যক্তি গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। রাজধানীতে তার রয়েছে কয়েকটি বাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লট। ব্যাংকেও রয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা।
চলতি বছরের এপ্রিলে বহুল আলোচিত কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামানকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে আবু বকর সিদ্দিকের ঘুষ-বাণিজ্য। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শামসুজ্জামান জানিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে দুদকে থাকা অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিবর্তনের কথা বলে আবু বকর দাবি করেন ৬০ লাখ টাকা। ওই টাকা নিয়ে আবু বকরের বাসায় গেলে তিনি টাকা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, সেগুলো ডলার বা ইউরো করে নিয়ে আসতে। শামসুজ্জামান বাধ্য হয়ে ডলারে কনভার্ট করে ৬০ লাখ টাকা দেন আবু বকরকে। চাঞ্চল্যকর এই তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর তার ঘুষ, দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে দুদক। বেশ কিছুদিন আগেই একজন পরিচালককে তার বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
কালবেলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও চাকরিকালে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন আবু বকর। রাজধানীর অভিজাত এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকটি ভবনসহ ডজন খানেক প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। তাকে টাকা দিলেই মিলে যেত দুদকের ‘ক্লিনশিট’। দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতে তিনি ঘুষ নিতেন ডলার ও ইউরোতে। তার দুই ছেলে থাকেন যুক্তরাজ্যে। ঘুষের টাকা সেখানে পাঠিয়ে দেন হুন্ডিতে। আর সেই টাকা ‘রেমিট্যান্স’ হয়ে আবার চলে আসে আবু বকরের কাছে।
আবু বকরের সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুদকে তদবির বাণিজ্য সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা ছিলেন আবু বকর। ছিলেন দুর্নীতিবাজদের রক্ষক। দুর্নীতিবাজদের সব সমস্যার ‘মুশকিল আসান’ ছিলেন তিনি। টাকা নিয়ে দুদকের মামলার দায়মুক্তি পেতে সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির চিঠি ইস্যু করে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করতেন এই কর্মকর্তা। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অবসরে যাওয়ার আগে তার সর্বশেষ বেতন ছিল সর্বোচ্চ ৫০-৬০ হাজার টাকা। অথচ তার সম্পদের ফিরিস্তি দেখে খোদ দুদক কর্মকর্তাদেরও ভিরমি খাওয়ার উপক্রম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দুদকের অসাধু কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক ছিলেন সাবেক এই উপপরিচালক। যতই অপরাধ থাক না কেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ করে চাহিদামতো ঘুষ দিলে দুর্নীতিবাজরা অভিযোগের অনুসন্ধান ও মামলা থেকে দায়মুক্তি পেতেন। এজন্য দুর্নীতির জালে আটকালে বা মামলা হলেই আবু বকরের কাছে যেতেন অভিযুক্তরা। আবু বকর তার সিন্ডিকেট ব্যবহার করে তাদের দায়মুক্তির ব্যবস্থা করতেন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইলের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন আবু বকর। তার সিন্ডিকেটভুক্ত জুনিয়র কর্মকর্তাদের দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে নোটিশ ইস্যু করাতেন। তারপর শুরু হতো দেনদরবার। দুদকের মামলা থেকে বাঁচতে ও সামাজিক সম্মান হানির ভয়ে অনেকে আবু বকরের দ্বারস্থ হতেন। মোট অঙ্কের টাকা নিয়ে তিনি সব ‘মুশকিল আসান’ করে দিতেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কে-ব্লকের ১৭ নম্বর রোডে ১০ কাঠা জমির ওপর একটি ১০ তলা ভবন নির্মাণ করছেন আবু বকর সিদ্দিক। গত ১৪ সেপ্টেম্বর নির্মাণাধীন ওই ভবনে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির নির্মাণকাজ শেষের দিকে। নির্মাণকাজ তদারকির জন্য ভবনের পাশে একটি অফিস খুলে বসেছেন আবু বকর। ভবনে কর্মরত নির্মাণ শ্রমিক এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনটির মালিক দুদকের কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক। তিনি নিয়মিত পাশের টিনশেড অফিসে বসেন এবং নির্মাণকাজের তদারকি করেন। সরেজমিন পরিদর্শনের সময়ও আবু বকর ওই টিনশেড অফিসে ছিলেন। তিনি অফিসে আছেন নিশ্চিত হয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে ভেতর থেকে একজন বলেন, ‘স্যার (আবু বকর সিদ্দিক) জরুরি মিটিংয়ে আছেন। এখন দেখা করা যাবে না।’ পরে পরিচয় দিয়ে প্রতিবেদকের ভিজিটিং কার্ড পাঠানো হয়; কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মেলেনি।
এদিকে, ভাটারা থানাধীন নতুন বাজার এলাকায়ও আবু বকর সিদ্দিকীর একটি ১০ তলা আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের তথ্য নিশ্চিত হয়েছে কালবেলা। গত ১৬ সেপ্টেম্বর ভাটারার নতুন বাজার এলাকার ১০ তলার ভবনটিতে সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, ভবনটির নাম ‘মিয়া ভাই প্লাজা।’ ভবনের তৃতীয় তলায় পরিবার নিয়ে থাকেন আবু বকর সিদ্দিক। তিনি ভবনটির মালিক ও মালিক সমিতিরও সভাপতি।
ভবনটির দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক স্পেস। নিচ তলায় মাদ্রাসাতুল আবরার নামে একটি মাদ্রাসা এবং একটি ওষুধের দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। দোতলায় রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের একটি উপশাখা। এ ছাড়া নিচ তলায় ব্যাংকটির একটি এটিএম বুথ রয়েছে।
ভবনের একাধিক বাসিন্দা জানান, ভবন মালিক আবু বকর বাড়ির মালিক সমিতির সভাপতি। মাদ্রাসার এক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেন, আমরা আবু বকরকে ভাড়া দিই। যতটুকু জানি উনি এই ভবনের বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটের মালিক, পুরো ভবনটি তার কি না বলতে পারব না। আবু বকরের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ওই ভবনের দারোয়ান জানান, তিনি বাসায় নেই। ভবনের মালিকানার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে প্রথমে স্বীকার করেন; কিন্তু পরে বলেন, ‘আমি কিছু জানি না।’ যদিও তিনি আবু বকরের নিজ এলাকা জামালপুরে বাড়ি হওয়ার কারণে শুরুতেই দারোয়ানের কাজ করছেন।
রাজধানীর পূর্বাচলে আবু বকরের জমি থাকার তথ্য পেয়েছে কালবেলা। পূর্বাচলের ২৫ নম্বর সেক্টরে জয় বাংলা চত্বর সংলগ্ন ৫ কাঠা করে দুটি প্লটে ১০ কাঠা জমি আছে তার। সেখানেও বাড়ি নির্মাণকাজ প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া মুগদা বড় মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় একটি ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে আবু বকর তার জমিতে ১০ তলা ভবন তৈরি করছেন। সম্প্রতি সেখানে একজন ক্রেতা ফ্ল্যাট কিনতে যান। তিনি দুদক কর্মকর্তার ভবন শোনার পর ফ্ল্যাট না কিনে ফিরে আসেন। এর বাইরে রাজধানীর বনশ্রী, আফতাবনগর, উত্তর বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে ডজন খানেক ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে। নিজ জেলা জামালপুরেও রয়েছে বিপুল সম্পদ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গত এপ্রিলে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৮ সালে মামলা করে দুদক। সেই মামলা থেকে দায়মুক্তি পেতে দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক আবু বকরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় আবু বকর তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করার কথা জানিয়ে ৬০ লাখ টাকা দাবি করেন। তিনি নগদ টাকা নিয়ে বাসায় গেলে ওই টাকা ডলারে কনভার্ট করে দিতে বলেন। শামসুজ্জামান স্বীকারোক্তিতে বলেন, আবু বকরকে ৩০ লাখ টাকার সমপরিমাণ ডলার দেন। এতে বদলে যায় তদন্ত কর্মকর্তা। শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে থাকা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদকের উপপরিচালক গোলাম মাওলাকে। এই কর্মকর্তাও বিভিন্ন সময় শামসুজ্জামান ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা দিয়েছেন। টাকা পেয়ে গোলাম মাওলা তাকে মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশসহ কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেন। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত আরও কয়েকজন কর্মকর্তাও এ ধরনের তথ্য জানিয়েছেন।
আবু বকর তার দুর্নীতির সিন্ডিকেটভুক্ত করেছেন দুদকের একাধিক পরিচালক, মহাপরিচালক ও কমিশনারকেও। এখনো দুদকের একজন কমিশনারের সঙ্গে সখ্য রয়েছে তার। তিনি ওই কমিশনারের ক্যাশিয়ার বা কালেক্টর হিসেবেও কাজ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অবসর গ্রহণের পরও ওই কমিশনারের মাধ্যমে আবু বকর এখনো দুদকে তদবির বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।
আবু বকরের বিরুদ্ধে উত্থাপিত নানা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশন সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন কালবেলাকে বলেন, ‘তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’
আবু বকরের বেশুমার দুর্নীতির বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কারবিষয়ক কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘এ ধরনের কর্মকর্তাদের জন্য দুদকের যারা সৎভাবে কাজ করতে চান, তারা সবসময় কোণঠাসা হয়ে থাকেন। যেখানে অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনা দুদকের নিজস্ব ম্যান্ডেট, সেখানে সেই অপরাধ দুদক কর্মকর্তা নিজেই করেছেন। এই কাজে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় এটাকে তারা অবৈধ সম্পদ বিকাশের সুযোগ হিসেবে নিচ্ছেন। অভিযুক্তদের সঙ্গে এক ধরনের মধ্যস্থতা বা দালালির মাধ্যমে তারা অবৈধ সম্পদের মালিকানা অর্জন করেছেন। এটা তারই বড় উদাহরণ। অবসরে গেলেও তদন্তের মাধ্যমে এই কর্মকর্তাকে অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি শস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘শর্ষের মধ্যে ভূত’ প্রবাদে যে কথাটা বলা হয়, তার একটি প্রকট দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই আবু বকরের বিষয়টি। সাধারণ মানুষের ধারণা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদকের কার্যক্রম ব্যাহত হয়, সেটা যেমন ঠিক, একইভাবে এ ধরনের কর্মকর্তারাই দুদককে আরও বেশি অথর্ব ও অকার্যকর করে রেখেছে।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে দুদকের সাবেক উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিকের ভাটারার বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নির্মাণাধীন বাড়ির অফিসে তিনি থাকলেও এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। পরে কয়েক দফা মোবাইলে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিলেও কোনো উত্তর দেননি।