অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে সংস্কার শেষে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব বলে মনে করেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। তার মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা-বিশ্বাস নিয়েই সরকারকে সংস্কার ও নির্বাচনী টাইমফ্রেম ঠিক করতে হবে। কালবেলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন আলোচিত তরুণ রাজনীতিক নুর। এ সময় তিনি শেখ হাসিনার পতন-পরবর্তী প্রশাসন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক, সমন্বয়কদের করণীয়সহ নানা বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজকুমার নন্দী
কালবেলা: বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন চায়। এ ব্যাপারে গণঅধিকার পরিষদের অবস্থান কী?
নুরুল হক নুর: দীর্ঘ দেড় দশক ধরে এই দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। অবশেষে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব আমরা যাতে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেতে পারি এবং এ দেশের জনগণের সেই কাঙ্ক্ষিত ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচিত হতে পারে, যারা রাষ্ট্র চালাবে—এটাই আমাদের সবার আকাঙ্ক্ষা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের প্রতিও দল-মত সবার সমর্থন আছে। তবে এই সরকার তো একটি টেম্পোরারি (অস্থায়ী) সরকার। আগের সরকার পালিয়ে যাওয়ায় তাদের সাময়িক সময়ের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর আগে দীর্ঘ দেড় দশক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে নষ্ট করে দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার কতদিনের মধ্যে রাষ্ট্রকাঠামোর কতটুকু রিফর্ম করতে চায়, সেটা নির্ধারণ করে নির্বাচনের দিকে যাওয়াটাই আমাদের দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
কালবেলা: বিএনপিসহ সমমনাদের অভিযোগ, শেখ হাসিনার পতন হলেও প্রশাসনে এখনো বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদপুষ্টরাই বহাল রয়েছেন এবং নতুন পদায়নের ক্ষেত্রেও ঘুরেফিরে তারাই প্রাধান্য পাচ্ছেন। এ বিষয়ে আপনাদের অভিমত কী?
নুর: যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদ্যমান কাঠামোতে আনুগত্য প্রদর্শন করতে এবং তাদের লাইনে কাজ করতে অনেকাংশে বাধ্য থাকে। তার পরও কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, যারা নীতিনৈতিকতা-ব্যক্তিত্বের প্রশ্নে আপসহীন থাকেন। সরকার গত দেড় দশকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছে, সরকারি চাকরিতেও দলীয় লোকদের ঢুকিয়ে দলীয়করণ করেছে। এর ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-দপ্তরের দায়িত্বে বিগত সরকারের অনুগত কিংবা সরকার সমর্থকরাই রয়েছেন। এটার পরিবর্তন দরকার। সেই পরিবর্তনটা হয়তো রাতারাতি করা অসম্ভব হবে। পর্যায়ক্রমে এই পরিবর্তন করা যেতে পারে। আমরা দেখেছি, কয়েকদিন আগে ৫৬ জন ডিসি নিয়োগ হয়েছে, যাদের ৪৯ জনই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিভিন্ন সুবিধাভোগী বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। ডিসি-এসপিরা একটি জেলাকে বিভিন্নভাবে পুরো নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। ফরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীরাই যদি এখন আবার ডিসি হিসেবে নিয়োগ পান, সেক্ষেত্রে তারা এই সরকারকে অস্থিতিশীল করবে। ফলে সরকার জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশকে স্থিতিশীল করে একটা সুন্দর নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না। সেজন্য সৎ-সাহসী-পেশাদার অফিসারদের মূল্যায়ন করা দরকার।
কালবেলা: বিএনপির দাবি, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তাদের সমর্থন ও ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। তাদের ৪২২ জন নিহতও হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনের সমন্বয়করা বিএনপিকে অনেকটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য দিচ্ছেন বলে দলটির অভিযোগ। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
নুর: এটা ঠিক যে, একটা গণঅভ্যুত্থান হয়েছে—এখানে রাজনৈতিক দলের অবদান আসলে অনেকে স্বীকার করতে চায় না, প্রচার করতে চায় না, তুলেও ধরতে চায় না। কিন্তু এটা তো বাস্তব, দেড় মাসে তো আর বিপ্লব হয়ে যায় না। দেড় মাসও না, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই চীন থেকে ফিরে এসে প্রেস ব্রিফিংয়ে ‘রাজাকার’ শব্দ বলে সবাইকে বলা চলে ক্ষুব্ধ করেছেন। এরপর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটল। ২০ দিনে তো আর বিপ্লব হয়নি। এই বিপ্লবের জন্য তো দীর্ঘদিনের একটা প্রেক্ষাপট ছিল। প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল, ছাত্ররা সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছিল। গত দেড় দশকে সংগ্রামটা কিন্তু এই রাজনৈতিক দলগুলোই করেছে। এমনকি আমাদের মতো একটা উদীয়মান দল (গণঅধিকার পরিষদ), আমাদের ১২ জন নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। আমি নিজে ২৫ বার হামলার শিকার হয়েছি। ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েও কতটা লাঞ্ছিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত হয়েছি, গ্রেপ্তার হয়েছি, সেটা দেশবাসী দেখেছেন। এই পরিবর্তনের জন্য দেড় দশক ধরে আমার মতো এমন শতসহস্র লক্ষাধিক মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল। সবকিছু মিলিয়েই এই বিপ্লব এবং গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোরই অবদান বেশি। রাজনৈতিক দলগুলো এর জন্য সাফারার (ভুক্তভোগী) হয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। যারা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল, অধিকাংশেরই কিন্তু রাজনৈতিক পরিচয় আছে। কোনো না কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে তারা সংযুক্ত। এখানে অনেক ছাত্রনেতা ছিল, যারা আমার সঙ্গে রাজনীতি করেছে, সহযোদ্ধা ছিল। সব দল-মতের মানুষ, শিক্ষার্থী সমর্থন দিয়েছে বিধায় এটা গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। সুতরাং এখানে কারও এককভাবে কৃতিত্ব নেওয়ার খুব একটা সুযোগ নেই। কেউ যদি সেটা জাহির করে, সেটা তার সংকীর্ণ মানসিকতা—ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতে হবে।
আওয়ামী লীগ যেমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি করেছে, মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের একক সম্পত্তি-দলীয় সম্পত্তি বানানোর চেষ্টা করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের একক নেতা হিসেবে মহিমান্বিত করার চেষ্টা হয়েছে; এই আন্দোলনেও তেমন সাইন-সিমটম দেখতে পাচ্ছি। অংশগ্রহণকারী বাকি সবার অবদানকে এক প্রকার অস্বীকার করে শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা সমন্বয়কদের পাহাড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা বোধহয় ন্যায়সংগত নয়। প্রত্যেকের অবদান আছে, প্রত্যেককে শ্রদ্ধা-সম্মান করতে হবে। এই আন্দোলনে বিএনপির কর্মী সবচেয়ে বেশি মারা গেছে। এরপর হয়তো জামায়াত, তারপর গণঅধিকার পরিষদ। আমাদের ১২ জন কর্মী মারা গেছে। এখন যাদের সংগঠন থেকে কেউ মারা যায়নি, তাদের কি কোনো অবদান নেই? কে, কেন মারা গিয়েছে, সেটা আল্লাহই জানেন। কারণ, এটা আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন—কার মৃত্যু কখন কীভাবে হবে, এখানে কারোর হাত নেই। আমরা যেটা বলতে চাই, সবার অবদান, সবার ত্যাগ আছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন আমরা যে স্লোগানটা বলছি, ‘দল নয়, মত নয়, সবার আগে বাংলাদেশ, সবাই মিলে গড়ব দেশ’। এখন সবার আগে বাংলাদেশকে একটি মানবিক, সমৃদ্ধ ও কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য, সেখানে সবাই মিলে কাজ করতে হবে। এখন যদি আমরা কে কী করেছি, সেটা জাহির করার জন্য নিজেদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করি, নিজেরা যদি একে অন্যের বিরুদ্ধে লেগে থাকি, আবার আওয়ামী ফ্যাসিবাদ চলে আসবে এবং আমাদের এই বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে তারা পুনর্বাসিত হবে। এই বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা দরকার।
কালবেলা: একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের কতদিন মেয়াদ থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
নুর: অন্তর্বর্তী সরকার কতদিন থাকবে, সে ব্যাপারে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজকে আলোচনা করে একটা নীতিগত সিদ্ধান্তে যেতে হবে। এখন সরকার বলছে, জনগণ যতদিন চায়, ততদিন থাকব। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত রোডম্যাপ দেওয়ার জন্য বলছে। রাজনৈতিক দল ও সরকার বলা চলে একটা ঠেলাঠেলির জায়গায় আছে। এখন রাজনৈতিক দলও একটা রোডম্যাপ দিতে পারে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা এই সংস্কার প্রত্যাশা করি এবং এর জন্য এতদিন সময় প্রয়োজন। এর ফলে সরকারের দিক থেকেও একটা প্রতিক্রিয়া আসতে পারে যে, রাজনৈতিক দলগুলো এটা বলেছে, সুতরাং আমরা এতদিন থাকতে চাই।
অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থনটা হবে বিরোধী দল, বিশেষ করে কথিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যেসব বিরোধী দল আন্দোলন করেছে। সেখানে সরকারের সঙ্গে কিন্তু বিরোধী দলের আস্থা-বিশ্বাসের সম্পর্কে একটা বড় ধরনের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা যদি হয়, সেটা সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে না, দেশের জন্যও ভালো হবে না। অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারগুলো করবে, ভালো ভালো কাজগুলো করবে, সেটার জন্য তো জনসমর্থন লাগবে। জনসমর্থন বলতে এই ভাসা ভাসা ছাত্র-জনতা, আমজনতা তো দেবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর একটা সুসংগঠিত কাঠামো আছে। তাদের আদর্শিক কর্মী আছে সারা দেশে। তারা দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে দেশের মানুষকে যেভাবে মোটিভেট করতে পারে, সাধারণ মানুষ তো সেটা পারে না। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা-বিশ্বাস নিয়েই এই সরকারকে সংস্কারের দিকে যেতে হবে, টাইমফ্রেম ঠিক করতে হবে।
কালবেলা: বিএনপি বলছে, নির্বাচিত সরকার ও পার্লামেন্টের মাধ্যমে সংবিধানসহ রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কারের বিকল্প নেই। বিগত সরকার প্রশাসনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণ করায় একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, কেবল ততটুকু সংস্কার করবে এই সরকার। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
নুর : রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কী কী সংস্কার চায়, সেটা তারা তাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বলতে পারে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আমাদের মতো উদীয়মান দল, শক্তির জন্য একটা চরম বিপদ। আমাদের কোনো কথা অন্য রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে গেলে তারা আমাদের পেছনে লেগে পড়বে। আবার সরকারের বিরুদ্ধে গেলে তারাও আমাদের ভালো চোখে দেখবে না। বলবে, এরা তো আমাদের বিরুদ্ধে এখনই লেগে আছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে মূলধারার দলগুলোর তো ওপেন কথা বলা দরকার। অর্ধেক কথা মুখের মধ্যে রাখবেন আর অর্ধেক বলবেন—এভাবে তো পরিবর্তন হবে না। আমরা মনে করি, সরকার চাইলে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে একটা নির্বাচন করতে পারে। আবার যদি সরকার মনে করে, এর জন্য এক থেকে দুই বছর কিংবা তারও বেশি সময় লাগবে, সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ করে টাইমফ্রেম ঠিক করতে হবে। সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর এখনো কোনো আলাপ-আলোচনা বা মতবিনিময় হয়নি। মতবিনিময় হয়েছিল, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ছুটি থাকবে না, এটা তো আর পলিসি লেভেলের আলোচনা নয়। সুতরাং সরকারের রাজনৈতিক দল এবং অন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঠিক করা দরকার।