রাষ্ট্রের জরুরি সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য সম্প্রতি ৫৫ সদস্যের জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠিত হয়েছে। নবগঠিত এই প্ল্যাটফর্মের সদস্য সচিব হিসেবে আছেন ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক ও গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির (সম্প্রতি যার কার্যক্রম স্থগিত হয়েছে) আহ্বায়ক আখতার হোসেন। তিনি কমিটির সার্বিক বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাবি প্রতিনিধি মো. জাফর আলী
কালবেলা: আপনারা বলছেন, জাতীয় নাগরিক কমিটি রাষ্ট্র পুনর্গঠনে কাজ করবে। কাজটা কোন পদ্ধতিতে হবে?
আখতার হোসেন: আমরা বাংলাদেশের তরুণ-যুবকদের সংহতির ভেতর দিয়ে সংগঠিত করার একটি উদ্যোগ নিয়েছি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পুনর্গঠন ও সংস্কার যে দরকার, এ ব্যাপারে সবাই একমত। গণ-আলোচনার ভেতর দিয়ে জনস্বার্থের পক্ষে সরকারের নীতিনির্ধারণ যেন হয়, এমন নীতি-প্রস্তাব করার পক্ষে আমরা। একই সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানের সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতার পাশাপাশি জবাবদিহির আওতায় এনে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে কাজ করতে চাই।
কালবেলা: বিভিন্ন সেক্টরে সৃষ্ট খারাপ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে নাগরিক কমিটি কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
আখতার হোসেন: জাতীয় নাগরিক কমিটি মনে করে, বাংলাদেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব জায়গায় সক্ষম ও স্বনির্ভর হওয়া বাঞ্ছনীয়। জাতীয় নাগরিক কমিটি বাংলাদেশের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকেই পুনর্গঠন করার পক্ষে। আমরা মনে করি, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবস্থা বিরাজমান আছে, সেটা চলতে দেওয়া যায় না। আমরা সরকারের কাছে এই আহ্বান রাখব যে, যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশের পুলিশ স্টেশনগুলোকে প্রোপারলি অ্যাক্টিভ করুন। এ ছাড়া, যেখানে সংস্কার করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে দ্রুত হাত দেওয়ায় গুরুত্ব দিতে হবে এবং গঠিত কমিশনগুলো যেন দ্রুততার সঙ্গে তাদের কাজগুলো সম্পন্ন করে সে ব্যাপারেও আমরা সজাগ দৃষ্টি রাখতে চাই।
কালবেলা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী? এই সরকারকে কতদিন চান? কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনের কথা বলার চেষ্টা করছে, এক্ষেত্রে আপনাদের চিন্তা-ভাবনা কী?
আখতার হোসেন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে গঠিত হয়েছে। এই অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের শত শত মানুষ জীবন দিয়েছেন, হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে তাদের সবার আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা-ভাবনা ও চেতনাকে গুরুত্ব দিয়ে এই সরকার কাজ করবে, সেটাই আমাদের চাওয়া। আমরা এই সরকারকে জনসাধারণের পক্ষে নীতিনির্ধারণ করতে সহযোগিতা করতে চাই। তবে সরকারের কোনো ভূমিকা যদি জনস্বার্থ লঙ্ঘন করে তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে চাই। এই সরকার অন্য সময়ে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কাজ ছিল একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। যেহেতু এই সরকার একটি গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে গঠিত হয়েছে এবং সেই গণঅভ্যুত্থান স্পষ্ট একটি আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়েছে, সেই জায়গা থেকে রাষ্ট্রকে ও এর প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করতে, জনগণের পক্ষে নীতিনির্ধারণ করতে সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সেটা যেন অবশ্যই একটি পরিকল্পিত রূপরেখার মধ্য দিয়ে হয়। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বিদায় নিয়েছে; কিন্তু দেশে ফ্যাসিজমের নানাবিধ উপাদান এখনো রয়ে গেছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রটিকে সত্যিকারের রাষ্ট্র হিসেবে পুনর্গঠন করার পর নির্বাচনের বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দেওয়া দরকার, এর আগে নয়।
কালবেলা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষায় আপনাদের পরামর্শ বা ভূমিকা কী থাকবে?
আখতার হোসেন: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে এবং দেশের সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই ঘটনার এক মাস এরই মধ্যে অতিক্রম হয়ে গেছে। আন্দোলনে যারা সক্রিয় ছিলেন না এবং তখন যারা নির্লিপ্ত ভূমিকায় ছিলেন অথবা আন্দোলনের বিপক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই এখন বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরনের অসৎ, অন্যায্য ও অন্যায় কাজ করছেন। এটা সামগ্রীকভাবে হতাশাজনক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যারা সমন্বয়ক এবং সহ-সমন্বয়ক হিসেবে আছেন, তাদের দায়িত্ব হলো নিজেদের আরও বেশি সংগঠিত করা এবং গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে লিপ্ত হওয়া। সেই কাজকেই তাদের প্রধান কাজ হিসেবে দেখা উচিত।
কালবেলা: আপনাদের সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক কেমন হবে? আওয়ামী লীগের প্রতি আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
আখতার হোসেন: আমরা বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা এবং মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে একটি অভিন্ন বোঝাপড়ায় (কমন আন্ডারস্ট্যান্ডিং) পৌঁছাতে চাই, যেটা বাংলাদেশের স্বার্থকে রক্ষা করবে। বাংলাদেশের স্বার্থই হবে আমাদের সমস্ত আলোচনা, মতবিনিময় এবং কর্মকাণ্ডের ভিত্তি। এ জন্য আমরা অনেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসেছি এবং অনেকের সঙ্গে বসার প্রক্রিয়া চলমান আছে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই চায় না যে, ফ্যাসিবাদ ফিরে আসুক। অতএব, একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য তারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করবে, এটাই আশা করছি। আর আওয়ামী লীগ তো গণহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়া জনবিমুখ একটি দল। তাদের নির্দেশনায়ই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। জনসমর্থনের জায়গা থেকে আওয়ামী লীগ দেশে কতটুকু রাজনীতি করতে পারবে বা পারবে না, সেটা জনগণের ওপর নির্ভর করে; কিন্তু জাতীয় নাগরিক কমিটি চায়, এই গণহত্যা যারা ঘটিয়েছে, যারা নির্দেশ দিয়েছে, যারা গণহত্যায় সমর্থন করেছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের সবাইকে যেন আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। আমরা অবশ্যই রিকনসিলেশনের পক্ষে; কিন্তু যারা গণহত্যায় আনজাম দিয়েছে, তাদের শাস্তিবিহীন রিকনসিলেশনের পক্ষে আমরা নই।
কালবেলা: দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারত ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশসহ বহির্বিশ্বের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক রক্ষা করা উচিত বলে মনে করেন?
আখতার হোসেন: এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যখন সম্পর্ক স্থাপন করবে বা ধরে রাখবে, তখন তা অবশ্যই নিজ নিজ মর্যাদায় সমাসীন থেকেই করবে। বাংলাদেশের স্বার্থ লঙ্ঘিত হয় বা যাদের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে তারাই শুধু লাভবান হবে এবং বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, লাভের জায়গায় শূন্য থাকবে, এমন চুক্তি যেন কারও সঙ্গে না হয়। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সজাগ রাখতে হবে। আমরাও সজাগ দৃষ্টি রাখব।
কালবেলা: ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দল, সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের জন্য নিজ অবস্থান থেকে নাগরিক কমিটির প্রত্যাশা কী?
আখতার হোসেন: বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ নিজের জায়গা থেকে আজাদ হোক বা মুক্ত হোক, সেটা আমরা চাই। বাংলাদেশে যে সংকট রয়েছে সেই সংকটগুলো সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাই। তবে ভেতর থেকেই হোক আর বাইরে থেকেই হোক, বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার ব্যাপারে আমরা সোচ্চার। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা মিলে যে গণঅভ্যুত্থান সফল করেছে, তাদের চেতনাকে ধরে রেখে দেশ ও জাতির স্বার্থে কাজ করে যাওয়া, দেশকে সুন্দররূপে পুনর্গঠন করা এবং সংস্কারে সবার স্বতঃস্ফূর্ত ও আন্তরিক অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করি।
কালবেলা: আপনাকে ধন্যবাদ।
আখতার হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।