রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রেলওয়েতে বিগত সরকারের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হিসেবে আলোচনায় এসেছে দুটি নাম। তারা হলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সালাউদ্দিন রিপন এবং তার স্ত্রী মিফতাহুল জান্নাত লুনা। সারা দেশে ৩৭টি ট্রেনের ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে আলোচিত এই দম্পতির নিয়ন্ত্রণে চলে ৩২টি ট্রেন। চার বছরের জন্য ইজারা নিয়ে ক্ষমতাবানদের হস্তক্ষেপে তাদের সঙ্গে বারবার চুক্তি নবায়ন করেছে সরকার। এক্ষেত্রে প্রতিবারই সহযোগিতা পেয়েছেন রেলের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের। সব মিলিয়ে প্রায় এক যুগ ট্রেন ইজারার রিমোট কন্ট্রোল ছিল রিপন-রুনার হাতেই। এতে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে রেল।
জানা গেছে, ২০২২ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি বেসরকারি খাতে রেল পরিচালনার সব চুক্তি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে। কিন্তু সে সিদ্ধান্তও রাজনৈতিক বিবেচনায় আটকে যায়। মূলত রিপন-লুনা দম্পতির কারণেই সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে বেসরকারি খাতে রেল পরিচালনার বিষয়টি পরিবর্তনের চিন্তা করছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। যাদের হাতে ট্রেনের ইজারা ছিল, এখনো তারাই পরিচালনা করছে বলে রেলের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে।
রেলের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বশেষ ইজারা অনুযায়ী আরও অন্তত দুই বছর রিপন-লুনা দম্পতি ট্রেন পরিচালনার কথা রয়েছে। রেলওয়ের উচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত না এলে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পক্ষ ইজারা চুক্তি বাতিল সম্ভব নয়।
অবশ্য সরকারি খাতে ট্রেন পরিচালনায় লোকসান হলেও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ট্রেন চলে লাভজনকভাবে। দুই ধরনের ব্যবস্থাপনায় লাভ-লোকসানের বিপরীত চিত্রের কারণ চিহ্নিত করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ট্রেন পরিচালনা করে লোকসান দেয়। অথচ বেসরকারি খাতে ট্রেন লাভজনকভাবে চলছে। তাহলে সরকারি খাতে ট্রেন পরিচালনার সমস্যা চিহ্নিত করা দরকার। তাহলেই পরিস্থিতি বদলে যাবে। রেল খাতে প্রতি বছর রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে না।’
কে এই রিপন:
রেল অঙ্গনে সবার কাছেই ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে তিনি সুপরিচিত সালাউদ্দিন রিপন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ত্রাণ উপকমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ছিলেন রেলওয়ে শ্রমিক লীগের উপদেষ্টা। এ ছাড়া বরিশালকেন্দ্রিক এসআর সমাজকল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান তিনি। মূলত এই সামাজিক সংস্থার মাধ্যমে সহযোগিতা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে যেতেন এই নেতা।
জানা গেছে, বেসরকারি বিভিন্ন সেবা সংস্থার ঠিকাদারি কাজে অংশ নিতেন রিপন। প্রভাব খাটিয়ে বাগিয়ে নিতেন কাজ। বিপুল আয়ের অর্থের একটি অংশ এমপি হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এলাকায় খরচ করেছেন। বিশেষ করে নির্বাচন এলেই অর্থ ব্যয়ের উৎসবে মেতে উঠতেন এই সালাউদ্দিন রিপন।
রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সালাউদ্দিন রিপন বরিশাল-৫ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে এসব প্রতিষ্ঠানের নামে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে দরপত্রে অংশ নিয়ে ট্রেন পরিচালনার কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। দেশের বাণিজ্যিক রেলের প্রায় ৯০ শতাংশ কবজায় নিয়েছেন এই দম্পতি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ট্রেন পরিচালনার জন্য দরপত্রে অংশ নেওয়া সব প্রতিষ্ঠানই ছিল রিপনের। ফলে প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে খুব নিম্ন দরে টেন্ডারে অংশ নিয়েও কাজ পেয়েছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে কারচুপি বা অনিয়মের বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয় আর বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ সব নিয়মকানুন মেনে সূক্ষ্ম কারচুপির মধ্য দিয়ে রেলের লিজ নিশ্চিত করেছেন তারা।
মূলত চার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রেলে কাজ পেয়েছে এই দম্পতি। এর মধ্যে রয়েছে মেসার্স এসআর ট্রেডিং, এলআর ট্রেডিং, এনএল ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী সালাউদ্দিন রিপন। টিএম ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মিফতাহুল জান্নাত লুনা। এই চার প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা হিসেবে রাজধানীর ৭৮ মতিঝিল উল্লেখ রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যমতে, ট্রেন ইজারার জন্য খোলা দরপত্রে অংশ নেওয়া মেসার্স শান্তা ট্রেডার্স, এমকে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস ও রুবায়েত ট্রেড ইন্টারন্যাশনালও রিপনের অফিসের ঠিকানা ৭৮ মতিঝিলে পরিচালিত হচ্ছে। রেলওয়ে কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করে জানান, নামে-বেনামে রিপন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দরপত্রে অংশ নিতেন।
তথ্যমতে, বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে আট জোড়া ট্রেন বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করছে। এগুলো হচ্ছে বলাকা কমিউটার, মহুয়া কমিউটার, জামালপুর কমিউটার, দেওয়ানগঞ্জ কমিউটার, কর্ণফুলী কমিউটার, তিতাস কমিউটার ও সাগরিকা কমিউটার। এর সবকটিরই ইজারা পেয়েছেন রিপন-লুনা দম্পতি।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ৯৯ নম্বর ঢাকা কমিউটার, ৫ নম্বর আপ ও ডাউন কমিউটার এবং ৫৫৪ নম্বর লোকাল ট্রেন ইজারা নিতে দরপত্রে অংশ নেয় ৫টি প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠানই এই দম্পতির। ২৩-২৪ রকেট মেইল ও ২৭-২৮ চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনের দরপত্রে অংশ নিয়েছিল তিনটি প্রতিষ্ঠান। যার সবই রিপন-লুনা দম্পতির মালিকানাধীন।
১৫ নম্বর মহানন্দা, ৫৮৫ লোকাল ও ১৬ নম্বর মহানন্দা এবং ২৫/২৬ নম্বর নকশিকাঁথা এক্সপ্রেসের দরপত্রে অংশ নিয়েছিল তিনটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলোও রিপন-লুনার। এ ছাড়া বিভিন্ন বাণিজ্যিক ট্রেনের দরপত্রে অংশ নিয়ে কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন এই দম্পতি। অভিযোগ রয়েছে, এই দম্পতির অধীনে কর্মরত বিভিন্ন কর্মচারীও খোলা দরপত্রে অংশ নিয়ে বাণিজ্যিক ট্রেন পরিচালনার কাজ নিয়েছেন। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি ট্রেনের মধ্যে ১৬টি ট্রেনের পরিচালনার কাজও পেয়েছেন রিপন ও লুনা।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, মহানন্দা এক্সপ্রেস ট্রেনটি প্রতিদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও খুলনার মধ্যে যাতায়াত করে। ২০০৯ সালে এ ট্রেনটি ইজারা দেওয়া হয়েছিল রিপনের এলআর ট্রেডিংকে। তখন প্রতি ট্রিপে একটি কোচের ইজারা মূল্য ধরা হয়েছিল ৪০ হাজার ৭৬০ টাকা। সে সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে খুলনা পর্যন্ত একজন যাত্রীর ভাড়া ছিল ৬০ টাকা।
২০১৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে এই ভাড়া ৯৫ টাকা নির্ধারণ করা। অথচ তখন ইজারা মূল্য কমিয়ে ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ২৯ টাকা। অথচ একটি কোচও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৩ সালে ট্রেন পরিচালনার কাজ আবার বাগিয়ে নেয় রিপনের আরেক প্রতিষ্ঠান এনএল ট্রেডিং।
তথ্যমতে, চারটি প্রতিষ্ঠান এই দরপত্রে অংশ নিয়েছিল। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো এনএল ট্রেডিং, টিএম ট্রেডিং, মেসার্স শান্তা ট্রেডার্স ও এলআর ট্রেডিং। যার সবই রিপন ও তার স্ত্রী লুনার মালিকানাধীন। ফলে কারসাজি করে একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দরপত্রে অংশ নিয়ে খুব নিম্ন দরে কাজ পেয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, রিপনের চাচা ছিলেন ঢাকা রেলওয়ের ঠিকাদার। ২০০৪ সালে চাচার মৃত্যুর পর চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন রেলের দুনিয়ায় প্রবেশ করেন রিপন। এরপর রেলপথ মন্ত্রণালয় আর বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন রিপন। কারসাজির মাধ্যমে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্রে অংশ নিলেও তা মূল্যায়নের সময় বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্মকর্তারা আমলে নেননি। ফলে একই ব্যক্তিকে বিভিন্ন ট্রেনের পরিচালনার কাজ দিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে অধিক রাজস্বপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
অনিয়ম আর কারসাজি করে বিভিন্ন ট্রেন পরিচালনার কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রিপনের মোবাইলে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি আর জনসমক্ষে নেই। কিন্তু তার পরিচালনায় বেসরকারি খাতের সবকটি ট্রেন সচল রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী কালবেলাকে বলেন, ‘অনেক আগে থেকে এই দম্পতি বাণিজ্যিক ট্রেনগুলো পরিচালনার কাজ পেয়েছেন। খোলা দরপত্রের মধ্যেই তাদের কাজ দেওয়া হয়েছে। তাদের কাজ দিতে কোনো চাপ বা সরকারের প্রভাবশালী মহলের নির্দেশ ছিল কি না, তা বলতে পারব না।’
জানা গেছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে ট্রেন পরিচালনায় একক রাজত্ব ছিল রিপন দম্পতির। এই রুটে ১৩টি ট্রেন পরিচালনা করেন তিনি। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ২২ জুন থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রুটে প্রথমবারের মতো বেসরকারি মালিকানায় ট্রেনগুলো ইজারা দেওয়া হয়। দুই বছরের চুক্তিতে ট্রেনগুলো চুক্তিভিত্তিক বাণিজ্যিক পরিচালনার জন্য দেওয়া হলে রেলের আয়ও বেড়ে যায়। রেলের লোকবল সংকটসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন ধরে ধুঁকতে থাকা ট্রেনগুলো থেকে নিয়মিত অর্থ প্রাপ্তির কারণে এসআর ট্রেডিং নামের প্রতিষ্ঠানকে দুই দফায় চুক্তিমূল্য বাড়িয়ে ইজারা নবায়ন করা হয়।
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বেসরকারি খাতে ট্রেন পরিচালনা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারোয়ার কালবেলাকে বলেন, ‘ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন থেকে বেসরকারি খাতে সব ট্রেন স্বাভাবিক চলাচল করছে। এসব ট্রেনের ইজারা পরিবর্তনের কোনো খবর আমরা জানি না।’
বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে ট্রেন ইজারা সংক্রান্ত বিষয়টি দেখভাল করেন রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ এম সালাহ উদ্দীন। মূলত অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এ পদে আছেন রেলের এই যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন)। বর্তমান মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলী অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) পদ থেকে পদোন্নতি পাওয়ার পর সেখানে এখনো স্থায়ীভাবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
গত রোববার রেল ভবনে অতিরিক্ত মহাপরিচালকের কার্যালয়ে গিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়। এই দপ্তরে এ এম সালাহ উদ্দীন এক দিনও বসেননি বলে জানা গেছে। যুগ্ম মহাপরিচালকের কার্যালয়ের গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।