সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন ও শক্তিশালী—তা নিয়ে সবসময়ই বিতর্ক দেখা যায়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’ হিসেবে যেভাবে চায় সেভাবেই কাজ করে থাকে। সেজন্য কখনো সূক্ষ্ম কারচুপি, আবার কখনো স্থূল কারচুপির অভিযোগ ওঠে নির্বাচনে বিজয়ীদের বিরুদ্ধে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ক্ষমতাসীন সরকার সবসময় এমন দাবি করলেও গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন যথাক্রমে ‘একতরফা নির্বাচন’, ‘রাতের ভোট’, ও ‘ডামি’ ভোটের তকমা পেয়েছে। গণতন্ত্র সুদৃঢ় করতে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বারবার দাবি জানানো হলেও সবসময়ই তা উপেক্ষিত থেকেছে। সরকারের পাশাপাশি নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করার অপচেষ্টা করেছে নির্বাচন কমিশনও। এ অবস্থায় কমিশনের ব্যাপক সংস্কারের দাবি উঠেছে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর দেশে ১৩টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। এর মধ্যে ছয়জন সিইসিকে মেয়াদ শেষের আগেই বিদায় নিতে হয়েছিল। তাদের চারজন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গ্রহণযোগ্যতার সংকটে বিদায় নেন। সরকারের কাজে অসন্তোষ থেকে পদত্যাগ করেন একজন। আর একজন স্বাস্থ্যগত কারণে বিদায় নিয়েছিলেন। সর্বশেষ মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও তার আড়াই বছর গড়াতেই পদত্যাগ করে বিদায় নিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি একাই নন, তার সহকর্মী অন্য চার নির্বাচন কমিশনারও পদত্যাগ করেছেন।
আগে সরকারের ইচ্ছাতেই কমিশন গঠন করা হলেও নির্বাচন কমিশন নিয়োগে আইন পাস হওয়ার পর ২০২২ সালে গঠিত এ কমিশনটি পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। যদিও আইনটি নিয়ে সমালোচনা ছিল সবখানেই। আর যে সংসদে আইনটি পাস হয় সে সংসদও ছিল বিতর্কিত। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি এ কমিশনের অধীনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়। বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখে যে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ‘ডামি’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই নির্বাচনে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে মাত্র সাত মাসের মাথায় বিদায় দায় নিলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশন সংস্কারের জন্য এরই মধ্যে কমিশনও গঠন করে দিয়েছে সরকার। কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের লক্ষ্যে এরই মধ্যে সেই কমিশন অনানুষ্ঠানিকভাবে তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান এবং আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে কিছু ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। তবে অতীতে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশন এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি যাতে ক্ষমতাসীনরা অসন্তুষ্ট হতে পারে। আরেকটু সহজ করে বললে, অতীতের কমিশনগুলো নিজেদের শপথ ও সাংবিধানিক দায়িত্বকে ভুলে ক্ষমতাসীন দলের এজেন্ডাই বাস্তবায়নে তৎপর ছিল। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে অবশ্য তার ব্যতিক্রমও ঘটেছে।
নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সম্পর্কে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিশ্চিত ও সুরক্ষিত করা আছে। কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী যদি সরকার কাজ না করে, তাহলে আইনের বরখেলাপ হবে। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের মাধ্যমে নির্বাচন সংক্রান্ত আইন এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। তপশিল ঘোষণার পর আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রশাসনের মধ্যে রদবদল আনতে পারে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা হয়েছে, নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর থেকে বিভাগীয় কমিশনার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তাদের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া বদলি করা যাবে না। অন্যদিকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বদলি করার প্রয়োজন হলে নির্বাচন কমিশন লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবে। এরপর যত দ্রুত সম্ভব সে বদলি কার্যকর করতে হবে।
সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ নির্বাচন কমিশনকে যেমন ক্ষমতা দিয়েছে, তেমনি আবার আইনে অস্পষ্টতাও রেখে দিয়েছে। কারণ, কোনো নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করা কিংবা না করা হলে সেক্ষেত্রে কমিশন কী করতে পারে এটা নিয়ে সরাসরি আইনে কিছুই বলা নেই। সংবিধানে বলা আছে, নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে। কিন্তু যদি না করে বিষয়টি নিয়েও সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। আর এ সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছে অতীতের বিভিন্ন সরকার। যেমন ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন নির্বাচনের দুদিন আগে থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দিলেও তাতে সায় দেয়নি সরকার। বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা খানিকটা হতাশাও প্রকাশ করেছিলেন।
এদিকে অতীতের সরকারগুলো নির্বাচন কমিশনকে যেমন নিজেদের আজ্ঞাবহ হিসেবে দেখে আসছে, তেমনি নির্বাচন কমিশনও সরকারের সুনজর পেতে নিজেদের ক্ষমতাকে খর্ব করার চেষ্টা করেছে। ২০২২ সালের ১৯ মে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনী অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। নির্বাচন কমিশনের পরামর্শে নেওয়া সেই সংশোধনীতে বলা হয়, ‘নির্বাচনের পরে ফলাফল বাতিল করতে পারবে না কমিশন’। এতে নির্বাচন কমিশনের ‘ক্ষমতা খর্ব হয়েছে’ বলে সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়। তখন নির্বাচন কমিশনের সচিব গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে, নির্বাচনী কার্যক্রম ও ভোট চলাকালে নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা কমিশনের হাতে আছে। যে সংশোধনী যুক্ত করা হয়েছে সেটি হচ্ছে, নির্বাচনের ফলাফল গেজেট বা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হওয়ার পর পুরো নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করা যাবে না। পরে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে যে, ভোট চলাকালীন নির্বাচনের কমিশনের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা আছে। অবশেষে ভোট বন্ধে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা কমিয়ে গত বছর ৪ জুলাই বিরোধী দলের সদস্যদের তীব্র আপত্তির মুখে সংসদে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী বিল পাস করা হয়, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলে। এভাবে কখনো সরকার আবার কখনো নির্বাচন নিজেই নিজেদের ক্ষমতাকে কমিয়ে সরকারের তোষামোদিতে লিপ্ত হয়।
এর আগে নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার জন্য ২০১০-১১ সালে ওই সময়কার কমিশন যেসব সুপারিশ রেখে এসেছিল সেগুলোর ধারেকাছেও যায়নি পরবর্তী কমিশন। এসব সুপারিশের মূলে ছিল সংবিধানের ১৮ ধারায় বর্ণিত কমিশন গঠনের জন্য একটি কার্যকরী আইন তৈরীকরণ। এর নিমিত্তে একটি খসড়াও সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ছিল নির্বাচনী ব্যয় মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা, নির্বাচনকালে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে পরবর্তী কমিশনগুলো তা আমলে না নিয়ে উল্টো নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করার দিকেই বেশি মনোযোগী ছিল।
এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশন সংস্কারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কমিশনপ্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর থেকে মানুষের আস্থাই উঠে গেছে। জনগণের সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রচলিত আইনের কিছু কিছু স্থানে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। কমিশন সেই লক্ষ্যে কাজ করবে। আইনকে পুরোপুরি যুগোপযোগী করতে হবে। এই আইন দিয়ে যখন যিনি ক্ষমতায় থাকবেন, তখন তিনি যাকে খুশি তাকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করতে পারেন। সেই সুযোগ বাতিল করতে হবে।
সুজন সম্পাদক আরও বলেন, প্রচলিত হলফনামায় পরিবর্তন আনতে হবে। এটা ২০০৬ সালে আদালতের নির্দেশে চালু করা হয়েছিল। এটাকে যুগোপযোগী করতে হবে। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) মোটামুটি গ্রহণযোগ্য থাকলেও কিছু কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। আরপিওতে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার। এই ধারা সন্নিবেশ করার উদ্দেশ্য ছিল ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো যাতে দলীয় লেজুড়বৃত্তি বা লাঠিয়ালের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতেই করা হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কৌশলে এই আইন অমান্য করে ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন নাম দিয়ে একইভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আক্ষরিকভাবে মানলেও আইনের উদ্দেশ্য তারা মানেনি।
তবে নির্বাচন কমিশন সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরির আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার তিন মাস সময় দিলেও নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রস্তাব চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে জমা দেওয়া সম্ভব।