অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগ্রহে গত ১৩ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরকে। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আগের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পদত্যাগ করায় তাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। আজ ১৪ সেপ্টেম্বর গভর্নরের এক মাস পূর্ণ হচ্ছে। ব্যাংক খাতের নানা সংকট ও সম্ভাবনা এবং সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মৃত্তিকা সাহা
কালবেলা: আজ শনিবার আপনার দায়িত্বের এক মাস পূর্ণ হচ্ছে, এর মধ্যে ব্যাংক খাতের সংস্কারে কী কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
আহসান এইচ মনসুর: কাজ কেবল শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছি। এর মধ্য দিয়ে একক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যাংক খাতকে মুক্ত করা গেছে। একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছি। এই টাস্কফোর্সের দ্বারা প্রতিটি ব্যাংকে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ বের করব। তারপর কীভাবে এই ক্ষতি কাটানো যায় এবং সম্পদ উদ্ধার করা যায়, সেগুলোর বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কালবেলা: দায়িত্ব নেওয়ার আগে ব্যাংক খাত নিয়ে আপনার যে ধারণা ছিল, দায়িত্ব গ্রহণের পর কী দেখেছেন?
আহসান এইচ মনসুর: যা ধারণা ছিল, তাই হয়েছে। খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত।
ক্ষত অনেক গভীর। তবে উদ্ধার করা যাবে। সময় লাগবে। এই ক্ষত যেমন এক দিনে তৈরি হয়নি, তেমনি ক্ষত সারানোও এক দিনে সম্ভব নয়। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
কালবেলা: পুনর্গঠিত ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকটের ব্যাপক সংকট দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন?
আহসান এইচ মনসুর: এসব ব্যাংকে তারল্য সরবরাহের চেষ্টা করছি। ব্যাংকগুলোর তারল্য প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের গ্যারান্টির মাধ্যমে এসব ব্যাংকে অন্য ব্যাংক থেকে অল্প অল্প করে তারল্য সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আর আমানতকারীরা যেন তাদের টাকা একসঙ্গে তুলে না নেয়, সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আপাতত এসব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা নিয়েই চলবে। তবে এসব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরবচ্ছিন্ন তত্ত্বাবধানেই থাকবে।
কালবেলা: ব্যাংক মার্জারের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবেন কি?
আহসান এইচ মনসুর: ব্যাংক মার্জারের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আগে হিসাবনিকাশের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র বের করা হবে। এজন্য অডিটর নিয়োগ দেওয়া হবে। সেজন্য বাইরে থেকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বাইরে থেকে আন্তর্জাতিক মানের অডিটর এনে অডিট করানো হবে। যেন কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে।
কালবেলা: রিজার্ভ বাড়াতে কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন?
আহসান এইচ মনসুর: রিজার্ভ বাড়াতে আমরা বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমরা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। অন্যদিকে, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। ডলারের বাজার স্থিতিশীল আছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকেও রিজার্ভ সহায়তা পাওয়ার আশ্বাস মিলেছে। ফলে এখন আর রিজার্ভ কমবে না। ধীরে ধীরে বাড়বে।
কালবেলা: ব্যাংকের টাকা লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছেন?
আহসান এইচ মনসুর: এ বিষয়ে আলাদা একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এক দিনে হবে না। ধীরে ধীরে হবে। এই লুটপাটও যেমন এক দিনে হয়নি, সেটি আদায়ও এক দিনে হবে না। তবে আর যেন কেউ ব্যাংকের টাকা লুটপাট করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করব।
কালবেলা: পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন?
আহসান এইচ মনসুর: আর্থিক খাতে যে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছিল, বিশেষ করে এস আলম এককভাবে ৭টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এতে এসব ব্যাংক থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি চলে গেছে। এককভাবে ইমলামী ব্যাংক থেকেই প্রায় ৫০ লাখ টাকার বেশি নামে-বেনামে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়েছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে আলাদা একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে। সেই টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কালবেলা: ব্যাংক খাতের প্রতি গ্রাহকের এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এই আস্থা ফেরাতে কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন?
আহসান এইচ মনসুর: হ্যাঁ, এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, ব্যাংক খাতের প্রতি গ্রাহকের এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তবে আমরা সেটা পুনরুদ্ধারে কাজ করছি। ইতোমধ্যে গ্রাহকের আস্থা অনেকাংশে বেড়েছে। এর অংশ হিসেবেই ব্যাংক খাত থেকে যে ৭০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের বাইরে চলে গিয়েছিল, তা থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে ফিরে এসেছে।