ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ঘিরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা নিয়ে পুলিশের নির্দেশনায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে বিএনপিতে। দলটি মনে করছে, পুলিশের এই নির্দেশনা সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিগত ১৫-১৬ বছরে গুম-খুন, অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মী ও তাদের পরিবারকে মামলা করতে নিরুৎসাহিত করতে পারে। এই নির্দেশনার পর পুলিশও মামলা নিতে অনীহা দেখাতে পারে। পুলিশ ও প্রশাসনের দায়ী কর্মকর্তাদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কি না, সেই শঙ্কাও তৈরি হয়েছে বিএনপিতে।
দলটির নেতাকর্মীদের মতে, ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে পুলিশ ও প্রশাসনের অধিকাংশ কর্মকর্তা পেশাদারিত্ব না দেখিয়ে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এই সময়ে বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা, অত্যাচার-নির্যাতন, গুম-খুনের ঘটনায় তারা সরাসরি জড়িত ছিলেন। সুতরাং তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন ভুক্তভোগীদের প্রতিকার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ফলে ভুক্তভোগীদের দায়েরকৃত মামলায় দায়ীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মামলা দায়ের নিয়ে ভুক্তভোগী কোনো পরিবার যেন নিরুৎসাহিত না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মামলা নিয়ে সারা দেশে দলের ‘ভুক্তভোগী’ নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয় বিএনপি। এ ক্ষেত্রে দলটির অবস্থান হচ্ছে, কারও বিরুদ্ধে অহেতুক মামলা করা যাবে না। তবে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগের শাসনামলে গত ১৫-১৬ বছরে দল ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুনে যারা জড়িত; তথ্য-প্রমাণ-সাক্ষীসহ সংগঠিত উপায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে।
নির্দেশনা অনুযায়ী গুম-খুন-নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগী পরিবারগুলো ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা করেছে। দলটির নেতারা বলছেন, মামলা হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনোকিছু হয়নি। ফলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো যে ন্যায়বিচার পাবে, তারও নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থানও স্পষ্ট নয়। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো যাতে ন্যায়বিচার পায়, অন্তর্বর্তী সরকারকে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
বিএনপির তথ্যমতে, গত ১৫-১৬ বছরে দেড় লাখের বেশি মামলায় ৬০ লাখেরও বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা রয়েছেন। মামলার বাইরেও এই সময়ে দলটির সহস্রাধিক নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে অনেকে শিকার হন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের। পাঁচশর অধিক নেতাকর্মীকে গুম করা হয়। তাদের মধ্যে ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ এখনো অনেকে গুম রয়েছেন।
এদিকে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকালীন হত্যাকাণ্ড/ঘটনায় আদালত/থানায় মামলা দায়ের সংক্রান্ত বিষয়ে গত ১০ ডিসেম্বর নির্দেশনা জারি করে পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি বিভিন্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। চিঠিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেসব মামলা হচ্ছে, সেগুলোর প্রাথমিক তদন্তে কোনো আসামির সম্পৃক্ততা না পাওয়া গেলে মামলা থেকে তার নাম প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সঠিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এসব মামলায় কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বলেও নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর এক মাসে বিগত সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে প্রায় পৌনে তিনশ মামলা হয়েছে আদালতে এবং দেশের বিভিন্ন থানায়। এসব মামলায় নাম প্রকাশ করে আসামি করা হয়েছে ২৬ হাজারের বেশি মানুষকে; অজ্ঞাতপরিচয় আসামি রয়েছে দেড় লাখের ওপর। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি চালাতে নির্দেশ দিয়ে হত্যা এবং নির্যাতন চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে এসব মামলায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামেই ১৩০টির বেশি মামলার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, যার মধ্যে ১১৯টিতেই হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। বাকি ১১টি মামলা হয়েছে হত্যাচেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগে।
এ ছাড়া বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, গুম-খুন, ক্রসফায়ারে হত্যা, কর্মসূচিতে বাধা প্রদানসহ নানা অভিযোগে পুলিশের বর্তমান ও সাবেক অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আবদুল্লাহ আল-মামুন চৌধুরী, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম, হাফিজ আক্তার ও আসাদুজ্জামান, যুগ্ম কমিশনার খন্দকার নুরুন্নবী, সঞ্জিত কুমার রায়, বিপ্লব কুমার সরকার ও মেহেদী হাসান অন্যতম।
শহীদ পরিবারের ন্যায়বিচার পাওয়া প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কারা জড়িত, কারা গুলি চালিয়েছে, তা সবাই দেখেছে। তাদের কজন এখন পর্যন্ত আটক হয়েছে? দুজন ছাড়া কেউ তো হয়নি। এখন গ্রেপ্তার না করার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে যারা প্রকৃত অপরাধী, তারা সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। তবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হয়, তা দেখা উচিত। শহীদ পরিবার যাতে ন্যায়বিচার পায়, এখানে কারও কোনো আপসের সুযোগ নেই।
বিএনপি নেতারা বলছেন, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পুলিশ ও প্রশাসনের দলবাজ এবং গুম-খুনে জড়িত কর্মকর্তাদের কেউ যাতে বাইরে পালিয়ে যেতে না পারে কিংবা দোষীরা যাতে গ্রেপ্তার হয়, সে বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, বর্তমান সরকার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সরকার। বৈষম্যবিরোধী সেই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাড়াও ছাত্রদলসহ বিএনপির অঙ্গসংগঠনেরও শতাধিক নেতাকর্মী নিহত হয়।
জানা গেছে, মামলা নিয়ে পুলিশের এই নির্দেশনার পর করণীয় নিয়ে বিএনপিতে আলোচনা চলছে। এ নিয়ে শিগগির অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কথা বলতে পারে দলটি। তারা সরকারকে আবারও এই বার্তা দিতে চায় যে, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুম-খুন, নির্যাতন-নিপীড়নে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, ভুক্তভোগীদের প্রতিকার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এমন বার্তা তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ইতোমধ্যেই দিয়েছে।