চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলা। অনেকের কাছেই এটি ভয়ংকর এক জনপদের নাম। দুই যুগ ধরে সেখানে ঘটেছে একের পর এক গা শিউরে ওঠার মতো ভয়ংকর অপরাধ। হাজার হাজার মানুষকে নির্মম অত্যাচার, নিপীড়ন, গুম-খুন, হামলা-মামলা, জমি দখল, ধর্ষণ, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, যৌন নিপীড়নসহ এমন কোনো ঘৃণ্য কাজ নেই, যা হয়নি এই উপজেলায়। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বিএনপি-জামায়াতসহ প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক কর্মী, মুনিরিয়া যুব তাবলিগ কমিটির ভক্ত থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও নির্যাতিত হয়েছেন। হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। ভাঙচুর করা হয়েছে বাড়িঘর, মসজিদ, মন্দির, মাজার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তবুও প্রতিবাদ দূরের কথা, মুখ খুলতেও সাহস পায়নি কেউ। কারণ, সব অপরাধের মূল হোতা ছিলেন ওই এলাকার সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। দীর্ঘ ২৪ বছর রাউজানে ত্রাসের রাজত্ব চলেছে তার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একে একে মুখ খুলতে শুরু করেছে রাউজানের নির্যাতিত মানুষ।
গুম, খুন ও নির্যাতনের অভিযোগে এখন পর্যন্ত রাউজান ও চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা হয়েছে। চট্টগ্রাম-৬ আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্য ভারতে পালাতে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার আখাউড়া সীমান্তে বিজিবির কাছে ধরা পড়েছেন।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ফজলে করিম চৌধুরী ২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত রাজাকার তালিকায় থাকা একেএম ফজলুল কবির চৌধুরীর সন্তান। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে আওয়ামী লীগের বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) কর্মী ছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালে এনডিপির শীর্ষ নেতার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন ফজলে করিম। সেই সূত্র ধরে এনডিপির আলোচিত ক্যাডার এসকান্দরসহ ৪০ থেকে ৪৫ জনকে নিয়ে এনডিপি থেকে পদত্যাগ করেন। পরে নিকটাত্মীয় সাবের হোসেন চৌধুরীর মাধ্যমে রাউজানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। এমনকি ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলটির মনোনয়নও বাগিয়ে নেন। তবে সেবার বিপুল ভোটে হেরে যান। এরপর ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাচাতো ভাই বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ৭ হাজার ৩২৯ ভোটে হারিয়ে চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের এমপি নির্বাচিত হন ফজলে করিম চৌধুরী। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন তিনি।
সরেজমিন রাউজান ঘুরে জানা যায়, ফজলে করিম চৌধুরী ওরফে জুইন্যা এতটাই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ছিলেন যে তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল রাউজানবাসী। তিনি উপজেলাজুড়ে কায়েম করেছিলেন একনায়কতন্ত্র। শুধু বিএনপি, জামায়াত কিংবা মুনিরিয়া যুব তাবলিগ নয়, ফজলে করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে থাকলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এলাকা ছাড়তে হতো। তার কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না প্রশাসনেরও। উন্নয়ন কাজের টেন্ডার থেকে শুরু করে সরকারি নিয়োগসহ সবকিছুই হতো তার নির্দেশে। তাকে ম্যানেজ করা ছাড়া জনপ্রতিনিধি হওয়ার উপায় ছিল না কারও। নির্বাচিত হয়েও এমপির রোষানলে পড়ে পৌরসভার অফিসে যেতে পারেননি সাবেক মেয়র দেবাশীষ পালিত। দিনেদুপুরে হত্যা, অত্যাচার, গুম, হামলা, মামলা, ভাঙচুর ছিল তার নিত্যদিনের কাজ।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য গ্রেপ্তারের আগে বেশ কয়েক দিন এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর রাউজানের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে অনেকবার কল করা হলেও তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
রাউজানের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফজলে করিম চৌধুরীর অনুসারীদের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের তাদের অধিকাংশই সাবেক এনডিপি ক্যাডার।
অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল সাধারণ মানুষ:
গত ৫ আগস্ট রাতে ফজলে করিম চৌধুরীর বাগানবাড়ি থেকে এক কৃষি শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার নাম মুহাম্মদ ইউসুফ মিয়া (৫৫)। প্রায় এক বছর আগে তিনি সাবেক এমপির কাজ ছেড়ে দেন। পুলিশ জানায়, নিহত ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে।
নিহত ইউসুফ মিয়ার ছেলে মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, তার বাবা সাবেক সংসদ সদস্যের ওই বাগানবাড়ির ব্যবস্থাপকের কাছে মজুরি বাবদ ২৬ হাজার টাকা পাওনা রয়েছেন। পাওনা চাওয়ায় তার বাবাকে একাধিকবার শাসানো হয়েছে। পরে বাগানবাড়ির ভেতর তার বাবাকে খুন করা হয়।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাসান বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হাসান বলেন, এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী আওয়ামী লীগে যুক্ত হওয়ার পর ১৯৯৬ সাল থেকেই আমি এলাকায় যেতে পারতাম না। ২০১৯ সালে আমার আব্বা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শামসুল আলম মারা যান। আমার আব্বার জিয়াফত অনুষ্ঠানও চুপি চুপি করতে হয়েছে। তিনি রাউজানকে একটি আতঙ্কের উপজেলায় রূপ দিয়েছিলেন।
বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন:
২০১৭ সালের ২৯ মার্চ ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরুকে ফজলে করিমের নির্দেশে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় সাত বছর পর রাউজান থানায় মামলা দায়ের করেছেন তার স্ত্রী সুমি আক্তার। এতে সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরীসহ ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।
নুরুল আলমের স্ত্রী সুমি আক্তার বলেন, ‘আমার সামনে থেকে স্বামীকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
এবিএম ফজলে করিমের নির্দেশে আবু জাফর চেয়ারম্যানকে অপহরণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। লন্ডনভিত্তিক একটি অনলাইন টিভি চ্যানেলের টকশোতে সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান দাবি করেন, ২০০৮ সালের শেষদিকে রাউজানের একজন এমপি আমাকে একজন চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করে ক্রসফায়ার করতে বলে। সে এমপির আমি কথা শুনিনি।’
২০১০ সালের ২৭ মার্চ থেকে পরিবারের সদস্যরা সৈয়দ আবু জাফরের প্রতীক্ষায় আছেন। বিষয়টি তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তার সন্তান জিসানুর রহমান।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহসভাপতি সাবের সুলতান কাজল কালবেলাকে বলেন, ‘ফজলে করিম চৌধুরীর অত্যাচার-হয়নারি এত পরিমাণে ছিল যে মাটিও কান্না করত। আমার বিরুদ্ধে তিনি ৫০টির অধিক মামলা দিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম নগর থেকে শুরু করে এমন জায়গা নেই, যেখানে তিনি আমার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য মিথ্যা মামলা দেননি। আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরে কখনো এলাকায় যেতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘ফজলে করিম চৌধুরী ও তার ক্যাডার বাহিনী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরু, পৌরসভা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন হান্নান, উপজেলা যুবদল নেতা আবুল হাশেম, প্রবাসী যুবদল নেতা মুসা, রাউজান থানা যুবদল নেতা রিয়াজ উদ্দিন ভুলুসহ অনেক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। গুম করেছে অনেক নেতাকর্মীকে, তার কোনো হিসাব নেই।’
রাউজান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফিরোজ আহমেদের ছেলে ফাহিম মোহাম্মদ রিয়াদ কালবেলাকে বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই নিজ এলাকায় যেতে পারিনি। রাউজানের এমপি ফজলে করিম যেখানেই আমাদের খোঁজ পেয়েছেন, সেখানেই মামলা দিয়েছেন। ২০২০ সালে আমার দাদি এবং ২০২১ সালে দাদা মারা গেছেন। কিন্তু কোনো জানাজায় বাবাসহ আমরা কেউ যেতে পারিনি।’
সাবেক এমপি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘আমি নিজেই ১৭ বছর এলাকায় যেতে পারিনি। এমন কোনো থানা নেই, যেখানে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা দায়ের করা হয়নি।’
এমপির রোষানলে মুনিরিয়া যুব তাবলিগ:
রাউজানের কাগতিয়া, গহিরা, সুলতানপুর, মোহাম্মদপুর, কতদলপুর, গশ্চি নয়াহাট, পাহাড়তলী, পৌরসভাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, বিএনপির নেতাকর্মী ও মুনিরিয়া যুব তাবলিগ কমিটির বিভিন্ন ইউপিতে অবস্থিত অফিসগুলো ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছিল গত কয়েক বছর আগে। অনেকের বিরুদ্ধে সাবেক এমপি ফজলে করিমের নির্দেশে মামলা-হামলাও হয়েছে। ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত মুনিরিয়া যুব তাবলিগ কমিটি বাংলাদেশের প্রায় ৮০০ জন নেতাকর্মী ও ভক্তের বাড়িঘর ভাঙচুর, তাদের থেকে চাঁদা আদায় ও এলাকাছাড়া করেছে। ৭২৪ জন নেতাকর্মী ও ভক্তের নামে মামলা করেছে।
মুনিরিয়া তাবলিগের বেশ কয়েকজন সদস্য বলেন, তাদের সংগঠনটি একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। কিন্তু ফজলে করিম তাদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি মনে করতেন। এ কারণে এমপি মুনিরিয়া তাবলিগ কমিটি ধ্বংসের পাঁয়তারা করেন। তার নির্দেশে রাউজানের বিভিন্ন ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও গ্রামে খানকা শরিফ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
মুনিরিয়া যুব তাবলিগ কমিটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর কালবেলাকে বলেন, ‘রাউজানের মুসলিম জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ মুনিরিয়া যুব তাবলিগ কমিটি করেন। ফলে রাউজানের সাবেক এমপি ফজলে করিম চৌধুরী মনে করতেন, এই মানুষগুলো তার কথায় উঠবস করবে না। ওনার ধারণা ছিল, দরবার থেকে কেউ স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করলেও আমরা জিতে যাব। ফলে তার সিটটা হয়তো চলে যেতে পারে। তিনি আমাদের হাজার হাজার মানুষকে বাড়িছাড়া করেছেন, মামলা দিয়েছেন। ভেঙে দিয়েছেন শত শত মানুষের বাড়িঘর। আমার বাড়িও তিনি একাধিকবার ভেঙেছেন।’
মুনিরিয়া তাবলিগের বিরুদ্ধে এমপি ফজলে করিমের ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায় ছেলে ফারাজ করিমের ফাঁস হওয়া একটি কলরেকর্ড। এতে তিনি ফেসবুকে মুনিরিয়ার বিরুদ্ধে কমেন্ট করার জন্য সেন্ট্রাল ভয়েসের সভাপতি সাইদুলকে একশ মানুষ জোগাড় করার নির্দেশনা দেন।
ত্রাসের রাজত্বে এলাকাছাড়া ত্যাগী নেতারাও:
আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর অভিযোগ, ফজলে করিমের নির্যাতনে তারাও অতিষ্ঠ ছিলেন। প্রকৃত আওয়ামী লীগের অনুসারীদের আদর্শ বলা হয় যাকে সেই মুসলিম উদ্দীন খানও ফজলে করিমের নির্যাতনে প্রায় ১০ বছর নিজ এলাকাছাড়া ছিলেন। মুসলিম উদ্দিন খান রাউজান উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে চাওয়া পর থেকে এমপির রোষানলে পড়েন।
২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্ব, রাউজান পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক দেবাশীষ পালিত। কিন্তু শুরুতে এক-দেড় মাস ছাড়া মেয়াদের বাকি সময় তিনি অফিস করতে পারেননি। এমপির অত্যাচারে বাধ্য হয়ে শহরে বসে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে তাকে।
দেবাশীষ পালিত কালবেলাকে বলেন, ‘নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি স্বাভাবিকভাবেই জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে, কিন্তু আমি এলাকাতেই যেতে পারিনি। এমপি ফজলে করিমের নির্দেশে পুলিশ আমাদের কর্মীদের ইয়াবা, পুরোনো ভাঙা অস্ত্রশস্ত্রসহ মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে চালান দিত। তার কিছু বাহিনী সেখানে ছিল, তারা পুলিশের ছত্রছায়ায় ত্যাগী নেতাদের মারধর করত। আমাকে তিনি (ফজলে করিম) একপ্রকার কর্মীশূন্য করে ফেলেছিলেন। এমনকি আমার ফেসবুক পোস্টে কেউ লাইক-কমেন্ট করলেও তাকে ধরে নিয়ে বেদম প্রহার করা হতো। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও আমি রাউজানে বিরোধী দলের মতো পালিয়ে ছিলাম।’
জানা গেছে, ২০২০ সালে মেয়র পদে নির্বাচনের আগ্রহ প্রকাশ করায় দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতা শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বেবীর ছেলে সাইফুল ইসলাম চৌধুরী রানার রাউজানে
আসা-যাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
সাইফুল ইসলাম চৌধুরী রানা কালবেলাকে বলেন, ‘মেয়র নির্বাচনের আগে আমি ফরম কেন নিলাম, ফজলে করিম চৌধুরীর নির্দেশে আমার বাড়িতে হামলা করা হয়েছে। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর গত চার বছরে একবারের জন্য তাদের কবর জিয়ারত করতে যেতে পারিনি। ফজলে করিম চৌধুরী বলতেন, দল আমাকে রাউজানে মনোনয়ন দিয়েছে, সুতরাং আমি যা বলব তাই হবে। তার একক প্রভাবের কারণে রাউজানে দল লাইনচ্যুত হয়েছে। ফজলে করিমের মতো নেতাদের কারণেই আজ শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।’
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জানান, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনের মায়ের মৃত্যুর পর জানাজায় ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীকে আসতে দেননি এমপি ফজলে করিম। অনেককে মারধর, নির্যাতন ও অপমান করে তাড়ানো হয়। শুধু তাই নয়, রোটনের মায়ের কুলখানির মেজবানে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাবুর্চিকে মারধরসহ নানা কায়দায় তাণ্ডব চালানো হয়।
সব কাজে ২০ শতাংশ কমিশনে এমপির:
জানা গেছে, রাউজান উপজেলার সব ইটভাটা থেকে প্রতি বছর ফজলে করিম চৌধুরীকে ২ লাখ টাকা করে দিতে হতো। এ ছাড়া উপজেলার সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজের কাজের টেন্ডার পাওয়ার পর ঠিকাদারদের বাধ্যতামূলকভাবে এমপিকে ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চুয়েট এবং চট্টগ্রাম তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন কাজের ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশনের টাকা আদায় করতেন পাহাড়তলী ইউপি চেয়ারম্যান রোকন উদ্দিনসহ কয়েকজন।
সংখ্যালঘু নির্যাতন:
অসংখ্য সংখ্যালঘুর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছিল সাবেক এমপি ফজলে করিম চৌধুরী। তবে সেই সময় ভয়ে মুখ খুলতে পারেনি কেউই। দখল করা হয়েছে বহু সংখ্যালঘুর জায়গা।
বিভিন্ন মামলার এজাহার ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময়ের কলকাতা নিবাসী উপমহাদেশের বিশিষ্ট আইনবিশারদ ও বহু গ্রন্থের লেখক অ্যাডভোকেট নলিনী রক্ষিতের নোয়াপাড়া গ্রামের বাড়ির প্রায় ১৫ একর ও শহরের হাজারী লেনের জায়গা দখলে নিতে তার নাতি শ্রীকান্ত রক্ষিতকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। শ্রীকান্ত রক্ষিতের দেহ পাওয়া যায় হাটহাজারীতে এবং খণ্ডিত মস্তক পাওয়া যায় মিরসরাইয়ে। এ খুনের মামলায় তার বাবা বাদী হয়ে যে মামলা করেছিল, তাতে এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এক নম্বর আসামি ছিলেন। কিন্তু নানা প্রভাব খাটিয়ে মামলা থেকে রেহাই পান তিনি।
সরেজমিন স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফজলে করিমের বাড়ির পার্শ্ববর্তী বিশ্বাসবাড়ির জায়গা দখল করে তার মা ও বাবার নামে কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সাবেক এমপির সরাসরি উদ্যোগে নোয়াপাড়ার বিশিষ্ট জমিদার প্রয়াত মোক্ষদা রসুনের নামে নিজস্ব ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মোক্ষদা রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে নোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় করা হয়। জমিদার মোক্ষদা রঞ্জনের নিজস্ব ভূমির ওপর তৈরি করা রাস্তায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাবিরোধী লাল মিয়া টেন্ডলের নামে তোরণ করা হয়েছে।
রাউজান পৌর সদর জলিল নগর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের মূল্যবান জায়গার ওপর জোরপূর্বক দোকানঘর নির্মাণ করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ রাউজান নোয়াপাড়ায় ভক্তিপদ ভট্টাচার্যের নিজস্ব পৈতৃক বাড়িভিটা বিক্রি করতে বাধ্য করা হয় এবং মূল্যবান ৫ গণ্ডা জায়গা এমপিকে বিনা পয়সায় দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
এমপির নির্দেশে নোয়াপাড়ায় সরকারি জায়গা এবং অজয় ও সুজয় ভট্টাচার্যের পৈতৃক জায়গা মামলা চলাকালীন জবরদখল করে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে বিশাল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। নোয়াপাড়ায় ফজলে করিমের নির্দেশে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠার নামে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ছয় একর জায়গা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। চিকদাইর ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী জমিদার ভবিৎ সওদাগরের মন্দিরসহ প্রায় ৩৯ একর সম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত দীঘি ও ভূমি দখল করা হয়েছে। রাউজান সদরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী রামমোহনের (বায়মনের দীঘি) মহামূল্যবান বিশাল দীঘি দখল করে অবৈধভাবে বিক্রি হয়ে গেছে।
পাহাড়তলী ইউনিয়নের ঊনসত্তর পাড়ায় লিটন দাশের পৈতৃক ভূমি বিক্রির সময় ভূমির মূল্য বাবদ পাওয়া টাকা থেকে ১ কোটি টাকা এমপি ফজলে করিমকে প্রদান করতে হয়েছে। শ্রীশ্রী জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবু গৌরাঙ্গ দের নোয়াপাড়ার গ্রামের বাড়ির সম্পত্তি এমপির নামে লিখে দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, যে বাড়িতে ঘরবাড়ি ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত মন্দির এবং পূর্বপুরুষদের শ্মশান রয়েছে। রাউজানে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্মস্থান হলেও রাউজান সদরে অবস্থিত সরকারি ডাকবাংলোটি স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী এমপির পিতা মরহুম ফজলুর কবির চৌধুরীর নামে নামকরণ করা হয়েছে।
ফজলে করিমের বিরুদ্ধে যত মামলা:
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গা ঢাকা দিয়েছিলেন সাবেক এমপি এবিএম ফজলে করিম। গত বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) তিনি ভারতে পালাতে গিয়ে আখাউড়া সীমান্তে ধরা পড়েন।
সরকার পতনের পর ফজলে করিমের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করেন ভুক্তভোগী মানুষ। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত রাউজান ও চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা হয়েছে।
আদালত ও থানা সূত্র থেকে জানা যায়, গত ১৯ আগস্ট চট্টগ্রাম আদালতে গুম করে হত্যার চেষ্টা, চাঁদাবাজি ও লুটপাটের মামলা করেন পশ্চিম গুজারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজউদ্দিন দৌলা। সেই মামলা এবিএম ফজলে করিমসহ ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। ২৩ আগস্ট রাউজান থানায় বাদী হয়ে হত্যা, ভাঙচুর, লুটপাট ও কোরআন পুড়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মামলা করেন মুনিরিয়া যুব তাবলিগ কমিটির ১০৩ নম্বর দলইনগর-নোয়াজিষপুর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আলাউদ্দিন। ফজলে করিম ও ফারাজ করিমসহ ৪৩ জনকে আসামি করে সেই মামলা করা হয়। ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম আদালতের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেন ইসতিয়াক হোসেন ওরফে বজল। সেখানেও ফজলে করিমসহ ২৩ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। একই দিন রাউজান থানায় ভাঙচুর, লুটপাট ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মামলা করেন মুনিরিয়া যুব তাবলিগ কমিটির ২০৪ নম্বর ফকিরটিলা শাখার সহসভাপতি মো. জোহেল উদ্দীন। ২৭ আগস্ট চট্টগ্রাম আদালতে রাঙ্গুনিয়ার বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। ২৮ আগস্ট পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন লালখানা বাজার এলাকার মো. দুলাল। ৩০ আগস্ট চান্দগাঁও থানায় হত্যা মামলা করেন বহদ্দারহাট এলাকার মো. শরীফ। মামলায় ফজলে করিম ও ফারাজ করিমসহ ৪৪ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। ১ সেপ্টেম্বর চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরুর স্ত্রী সুমি আক্তার।