রাজধানীর বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহে নিয়োজিত ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে (ডেসকো) বছরের পর বছর ধরে চলছে দেদার লুটপাট। অবাস্তব প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প ব্যয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি, নিয়োগের ক্ষেত্রে চরম আত্মীয়করণ, দুর্বল ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে টাকা আত্মসাৎ, কেনাকাটায় অতিরিক্ত ব্যয়, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণসহ এহেন কোনো অবৈধ কাজ নেই, যা এই প্রতিষ্ঠানে হয়নি। ডেসকো পরিচালনার নীতিই যেন ‘যেমন খুশি তেমন খাও’। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই লুটপাটে নেতৃত্ব দিচ্ছে কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট। অনেকটা প্রকাশ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি হলেও সবসময়ই নীরব ছিল বিদ্যুৎ ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। কারণ দুর্নীতিবাজ চক্রের প্রতি সাবেক মন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর আশীর্বাদ ছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলেও ডেসকোতে তার আঁচ লাগেনি। উল্টো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা একাট্টা হয়ে আগের মতোই লুটপাটে সহায়ক প্রকল্প পাস করাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে যে কোনো সময় বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের।
জানা গেছে, ‘ঢাকা পাওয়ার সিস্টেম এক্সপেনশন অ্যান্ড স্ট্রেনদেনিং’ প্রজেক্টের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের আওতায় কেনাকাটা বাবদ প্রায় ২শ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। নথিপত্র বলছে, এই ২শ কোটি টাকার কেনাকাটায়ও নেওয়া হয়েছে বড় অনিয়মের আশ্রয়। কোনো কোনো পণ্য দুই থেকে তিন গুণ বেশি ব্যয়ে কেনা হয়েছে।
তথ্য বলছে, আগে ডেসকোর রাজস্ব খাতের আওতায় যেসব পণ্য স্বল্পমূল্যে কেনা হয়েছিল, প্রকল্পে সেই একই পণ্য কেনা হয়েছে কয়েক গুণ দামে। এতে দেখা গেছে, প্রকল্পে স্ট্রেইট থ্রো জয়েন্টস ফর ৩৩ কেভি এক্সএলপিই, ১ কোর, ৫০০ এসকিউএমএম ইউ/জি কপার কেবলস কেনা হয়েছে প্রতিটি ১ লাখ ৪২ হাজার ৬২৩ টাকায়। অথচ আগে এটি কেনা হয়েছিল ৫৮ হাজার ৯৫০ টাকায়। প্রকল্পের কেনাকাটায় এর দাম ১৪২ শতাংশ বেড়ে গেছে। একইভাবে স্ট্রেইট থ্রো জয়েন্টস ফর ১১ কেভি এক্সএলপিই, ৩ কোর, ৩০০ এসকিউএমএম ইউ/জি কপার কেবলস ক্রয় করা হয়েছে প্রতিটি ৭৮ হাজার ৫৪৫ টাকায়। যেটি এর আগে রাজস্ব খাতে কেনা হয়েছিল ৪৯ হাজার ৯০০ টাকায়। অর্থাৎ ৫৭ শতাংশ বেশি টাকায় এটি কেনা হয়েছে। এ ছাড়া আউটডোর টারমিনেশন কিটস ফর ১১ কেভি এক্সএলপিই ৩ কোর, ৩০০ এসকিউএমএম ইউ/জি কপার কেবলস ক্রয় করা হয়েছে প্রতিটি ৬৩ হাজার ৪১৩ টাকায়। যেটি এর আগে ক্রয় করা হয়েছিল ৩৫ হাজার ১৫৯ টাকায়। অর্থাৎ ৮০ ভাগ বেশি টাকা দিয়ে এটি ক্রয় করা হয়েছে। শুধু উল্লিখিত পণ্যই নয়, পুরো প্রকল্পে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে এমন ধোঁকাবাজির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, ডেসকোর প্রধান প্রকৌশলী ছাড়াও নির্বাহী পরিচালক (সংগ্রহ) এ কে এম মহিউদ্দিন, প্রধান প্রকৌশলী (ডেভেলপমেন্টস অ্যান্ড প্রজেক্টস) শরিফুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী (প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন) জুলফিকার তাহমিদ ও মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে কেনাকাটা এবং লুটপাটের এ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। আর অনিয়ম পাকাপোক্ত করতে ডেসকো এবং মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্বজনদের চাকরি দেওয়া হয় ডেসকোতে।
সিন্ডিকেটের এমন ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতিতে বাড়ছে সিস্টেম লস, যা গড়ে বর্তমানে সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি। একসময়ের লাভজনক প্রতিষ্ঠানটিতে বাড়ছে লোকসান। ২০১৪ সালে নসরুল হামিদ মন্ত্রী হওয়ার আগে ডেসকো বছরে আড়াইশ থেকে ৪০০ কোটি টাকার বেশি লাভ করত। এখন মাসে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে।
তথ্য বলছে, নির্বিঘ্নে অর্থ আত্মসাতে যে কোনো প্রকল্প পাসের পর সিন্ডিকেটের পছন্দের ব্যক্তিকে প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন দপ্তর থেকে এমনভাবে মেটেরিয়ালের স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয়, যাতে বিশেষ প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদার কিংবা কোম্পানি ছাড়া অন্য কেউ কাজ না পায়। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই সাবেক বিদ্যুৎ মন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠানই কাজ পেয়ে আসছে ডেসকোতে।
জানা গেছে, ২০১২ সালে নেওয়া এসডিইডিএন অ্যান্ড ইউইডিএসজিসি প্রকল্পের ১১৫ কোটি টাকার অব্যবহৃত পণ্য ২০১৪ সালে রেভিনিউ খাতে স্থানান্তর করা হয়। এরপর পেরিয়ে গেছে ১০ বছর। কিন্তু সেই পণ্যগুলো এখনো ব্যবহার করা হয়নি।
‘সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট-অ্যাডভান্স মিটারিং ইনফ্রাস্টাকচার উইথ টু লাখ অব স্মার্ট মিটারস’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ২০২১-২২ অর্থবছরে। এই প্রকল্পের কাজ পায় শেখ রেহানার পুত্র রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী ববির ঘনিষ্ঠ অকুলিন টেক বিডি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পের শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয় ১৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এরপর ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৩৮৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। যদিও পরবর্তী সময়ে এটি আটকে দেওয়া হয় এবং ব্যয় ধরা হয় ৩১৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ডেসকোর কর্মকর্তারা বলছেন, মাত্র ২ লাখ মিটারের জন্য সোয়া তিনশ কোটি টাকা ব্যয় কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
জানা গেছে, অর্থ আত্মসাৎ করতে চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন ডেসকোর দুর্নীতিবাজরা। বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ওয়ার্কস ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরিধি এবং প্রজেক্টেড ভ্যালুও পরিবর্তন করে ৩৩০ কোটি টাকা নির্ধারিত হয়। এই কেনাকাটা থেকে অর্থ আত্মসাতে সুবিধার জন্য ‘ইনভাইটেশন অব ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডার’ ক্রয় কার্যটির নাম পরিবর্তন করা হয়। পরে এর আলোকে দুটি স্টেশন বেজড ফুললি অটোমেটিক মিটার টেস্টিং বেঞ্চ ক্রয় করা হয়। ক্রয়কৃত টেস্টিং বেঞ্চ নিম্নমানের উল্লেখ করে ডেসকোর টেস্টিং অ্যান্ড রিপেয়ারিং ডিভিশন লিখিতভাবে জানায়। এ ছাড়া এসব টেস্টিং বেঞ্চের বাজার মূল্য ৮ কোটি টাকার কম হলেও ১৭ কোটি টাকায় কেনে ডেসকো। এসব কেনাকাটা করা হয় এসএস করপোরেশন নামে একটি অখ্যাত কোম্পানির মাধ্যমে।
এ ছাড়া একই প্রকল্পের আওতায় এডেক্স করপোরেশনের মাধ্যমে ২৫০ কেভিএ ৬৯০টি ডিস্ট্রিবিউশন ট্রান্সফরমার ক্রয় করা হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ২৬ কোটি টাকা। এখানেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে ডেসকো। সংস্থাটির টেস্টিং অ্যান্ড রিপেয়ারিং ডিভিশনের প্রাপ্ত তথ্যে এখানে ২৫০ কেভি উল্লেখ করলেও ছিল ২০০ কেভির। তবে এমন জালিয়াতির আশ্রয় নিলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় ডাটা সেন্টার রয়েছে। যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দেশের সব প্রতিষ্ঠান। এই আলোকে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে ডাটা সেন্টার তৈরি না করতে নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়। এখানেও অর্থ আত্মসাতে চালাকির আশ্রয় নেয় ডেসকো। তারা ২০২১-২২ অর্থবছরে নেওয়া এস্টাবলিসিং ডাটা সেন্টার ফর ডেসকো প্যাকেজের নাম পরিবর্তন করে এস্টাবলিসিং মাস্টার ইনফরমেশন সেন্টার নামে ডাটা সেন্টার চালু করে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এই প্রকল্পের নামে ব্যয় করে প্রায় ৭২ কোটি টাকা।
জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ থাকলেও সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্কাডা প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণের উৎসব করে ডেসকো। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফাইবার এট হোমের সঙ্গে এক চুক্তিতে দেখা যায়, কেবল বিদেশে ট্রেনিংয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি টাকারও বেশি। এরই মধ্যে এই প্রকল্পের আওতায় ডেসকোর বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের নেতারা বিদেশে ভ্রমণ করেছেন। সরকারের পটপরিবর্তনের পরও ওই প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণে রয়েছে আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
নথিপত্র বলছে, ডেসকোর মামুনুর রশীদ ২০২২ সালে কানাডা, ২০২৩ সালে জার্মানি এবং ২০২৪ সালে সুইজারল্যান্ড ও জার্মানি সফর করেছেন। নন-টেকনিক্যাল কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিতভাবে বিদেশে টেকনিক্যাল প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের নামে বিদেশ ভ্রমণ করছেন।
নথিপত্র বলছে, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের সাতজন নেতা ডেসকোর টাকায় বিদেশ ভ্রমণে গেছেন। এ ছাড়া আগামী এক মাসের মধ্যে আরও অন্তত ২৫ জন প্রকৌশলী বিদেশ ভ্রমণে যাবেন, যারা মন্ত্রণালয় থেকে এরই মধ্যে অনুমতি পেয়েছেন।
এদিকে কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে তুলনামূলক দুর্বল ব্যাংকগুলোতে ফিক্সড ডিপোজিট করেছে ডেসকো। ফলে এখন প্রয়োজনীয় টাকা তুলতে পারছে না সংস্থাটি। এর মধ্যে সিটিজেন ব্যাংকে প্রায় ১১ কোটি, পদ্মা ব্যাংকে ১৯ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ২৫ কোটি, এনআরবি ব্যাংকে ৯ কোটি, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ৬ কোটি টাকা আমানত রয়েছে।
ডেসকোর কর্মকর্তারা বলছেন, আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংকে টাকা রাখার বিনিময়ে কিছু কর্মকর্তা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। কিন্তু এখন প্রয়োজনীয়তার সময় টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এসব ব্যাংকে নগদ টাকা নেই।
এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করায় গত এক বছরে ডেসকোর ফিক্সড ডিপোজিটের পরিমাণ ১ হাজার ৪১ কোটি টাকা থেকে মাত্র ৫৯৩ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান কালবেলাকে বলেন, ‘অনিয়ম সব জায়গায় হয়েছে। আপনারা লিখে যদি আমাদের নজরে আনতে পারেন, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব। যেসব অনিয়ম হয়ে গেছে, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অনিয়ম না হয়, সে বিষয়ে কঠোর তদারকি থাকবে।’