ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক মাস পূর্ণ করছে আজ। ৫৩ বছরের বাংলাদেশের ইতিহাসে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপট তৈরি হয় গত মাসে। ৮ আগস্ট রাষ্ট্র সংস্কারের অনিবার্য প্রয়োজনে যাত্রা শুরু করে ইউনূস সরকার। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে সঙ্গে আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। এমনকি, দলীয় নেতৃবৃন্দ ও সরকারঘনিষ্ঠ উচ্চ পর্যায়ের আমলারাও গা-ঢাকা দেন। গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনগণ। কর্তৃত্বপরায়ণ হাসিনা সরকারের নৃশংস দমন-পীড়নে প্রাণ হারায় শিশু-কিশোর-শিক্ষার্থী-নারীসহ হাজারো মুক্তিকামী মানুষ। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে জনতার এ বিজয়কে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করেন আন্দোলনকারীরা।
স্বৈরশাসন, দুর্নীতি, বৈদেশিক ঋণ, অর্থ পাচার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, রিজার্ভ সংকটসহ হাজারো সমস্যা থেকে উত্তরণে ড. ইউনূসকে সরকার গঠনে আহ্বান জানায় ছাত্র-জনতা। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন বিশ্বনন্দিত নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূস। পর্যায়ক্রমে আরও ২০ জন উপদেষ্টা যোগ দেন তার সঙ্গে। এর মধ্যে রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই শিক্ষার্থী।
এরই মধ্যে ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, স্থানীয় সরকারের পলাতক জনপ্রতিনিধি, বিচার বিভাগসহ নানা প্রতিষ্ঠানে গণপদত্যাগ, বিভিন্ন বঞ্চিত পেশাজীবীদের বিক্ষোভ, রাজনৈতিক দলগুলোর যৌক্তিক সময়ে নির্বাচনের দাবি ও আকস্মিক বন্যার মতো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে বর্তমান সরকারকে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা কালবেলাকে বলেন, এতবড় ঘটনার পর বড় রকমের বিশৃঙ্খলা হতে দেখিনি। এতে বলা যায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
পুলিশ বাহিনী সম্পূর্ণভাবে এখনো মাঠে নামতে পারেনি। আরও কিছুটা সময় লাগবে।
সাবেক এই আইজিপি মনে করেন, বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করেই নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করতে হবে। তবে, সংস্কার তো আগে দরকার হবে। এটা একটা নির্দিষ্টকালের মধ্যে ঠিক করতে হবে।
রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে লাগাতার বৈঠক করছেন প্রধান উপদেষ্টা। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি বিভিন্ন সময় অভিযোগ করছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে গেছেন শেখ হাসিনা। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দলদাসে পরিণত করা হয়েছিল। সব ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি। সংস্কারের প্রশ্নে তার সঙ্গে দেশবাসী একমত। তবে রাজনৈতিক ও সচেতন মহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়সীমা নিয়ে যথেষ্ট কৌতূহল রয়েছে।
সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না মনে করেন, দেশে অনেক ধরনের সংস্কার করা দরকার। এ জন্য দিনের পর দিন অনির্বাচিত সরকার থাকা ঠিক হবে না। একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদায় নেওয়া উচিত। সেটি ছয় মাসের মধ্যে হতে পারলে ভালো হয়।
বিভিন্ন মতবিনিময় সভায় বক্তারা সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলছেন। তবে, এই ‘যৌক্তিক সময়’ কতটুকু? তা নিয়ে আলোচনা চলছে সর্বত্র। গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় সম্পাদকদের মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। এতে দুই থেকে তিন বছর সময়ের কথা বলেছেন অনেকে। পরে, গণমাধ্যমকে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আমার মনে হয়, সর্বনিম্ন দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ তিন বছরের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ শেষ করা উচিত।’ দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক আবুল মোমেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দু বছর সময় দেওয়ার কথা বলেন।
পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, সব সংস্কারের দায়িত্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নয়। তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করবেন এবং দ্রুত নির্বাচন দিয়ে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনবেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সময়সীমা বেঁধে দেননি। তবে দ্রুত নির্বাচন চান। এদিকে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকার গঠনের আগের দিনই (৭ আগস্ট) সমাবেশ থেকে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। জামায়াত ও অন্য ইসলামী দলগুলোকে অপেক্ষাকৃত নমনীয় মনে হলেও, অনিবার্য লক্ষ্য নির্বাচন। কাজেই রোডম্যাপ ছাড়া সংস্কারের নামে অনির্দিষ্টকাল থাকতে পারবে না অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যে কারণে সব মহলেই কমন প্রশ্ন—কত দিন থাকবে এই সরকার?
গত বৃহস্পতিবারের শহীদি মার্চ থেকে রোডম্যাপ চেয়েছেন শিক্ষার্থীরাও।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম কালবেলাকে বলেন, এক মাস খুবই অল্প সময়। অন্তর্বর্তী সরকারের মূল্যায়নের সময় এখনো আসেনি। গত ১৬ বছরে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এখনো পুলিশ ও প্রশাসনের অনেকেই তাদের দায়িত্বে ফেরেনি। এ ছাড়া সব সেক্টরেই প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। এর পরই একটি সুন্দর নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসবে। কেন নির্বাচন কমিশনের জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায় না, সেগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। সেজন্য বর্তমান সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে অথবা সংসদ নির্বাচন কবে হওয়া উচিত, তা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া যাবে না। এর জন্য যতটুকু যৌক্তিক সময় প্রয়োজন সরকারকে সেই সময় দিতে হবে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে দেশে। বিশ্বের প্রায় সব দেশ তার সরকারকে সমর্থন করে সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছে। এমনকি, শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিলেও ভারত পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীল পরিস্থিতির অপেক্ষায় রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বেসরকারি সংগঠন পরিচালনায় দক্ষ মুহাম্মদ ইউনূস; অর্থনৈতিক দিক থেকে হয়তো রাষ্ট্রকে সঠিক পথে টেনে তুলতে সক্ষম হবেন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, দেশের আর্থিক খাতের অবস্থা মোটেও ভালো নয়। বিগত সরকারের সময় লাখ লাখ কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। এমন বাস্তবতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ফেরাতে যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, সেগুলো অবশ্যই ইতিবাচক। তিনি আরও বলেন, এসব সংস্কার কাজ এক বছরের মধ্যে শেষ হবে না। তবে আর্থিক খাতকে একটা স্বাস্থ্যকর জায়গায় নিয়ে আসার জন্য যত সময় লাগুক না কেন, সেটা তাদের দিতে হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাই হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সফলতার অন্যতম মাপকাঠি। প্রচলিত রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ উপদেষ্টাদের অনেকেই প্রশাসনে একেবারেই নতুন। এক্ষেত্রে তাদের সততা, ধৈর্য, সংযত ব্যবহার দিয়ে উতরে যেতে পারেন। সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার কালবেলাকে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটা বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেই দেশের দায়িত্ব নিয়েছে। তারপরও তারা মাত্র এক মাসেই বহুক্ষেত্রেই সফলতা দেখিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও যোগ্য এবং মেধাবীদের উপাচার্য করা হচ্ছে।
আউয়াল মজুমদার বলেন, প্রশাসনের বিশৃঙ্খলা সরকার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছে। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে আরও শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল হবে। তারপরই বড় বড় সংস্কারের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে তারা । আমি মনে করি, সরকার সঠিক পথে আছে এবং তারা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে।
সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে রাজপথে এখনো সক্রিয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ট্রমায় আক্রান্ত পুলিশের অনুপস্থিতিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে শিক্ষার্থীরা। ডাকাতি ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে রাত জেগে পাহারা দিয়েছে। বিশৃঙ্খল আনসারদের প্রতিহত করতেও এগিয়ে এসেছে তারা। বন্যার্তদের জন্য দেশজুড়ে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছিল শিক্ষার্থীদের আহ্বান। তাদের আত্মত্যাগ ও ভূমিকাকে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা সব সময় স্মরণে রাখেন। তারা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের মনোনীত সরকারের অংশ তারা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে কতদিন? জাতির সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার্থীর পাঠাভ্যাস স্বাভাবিক করতে হবে। শিক্ষার্থীকে এক সময় ক্লাসে ফিরে যেতেই হবে। যার যে কাজ সেটা নিরাপদ ও নিশ্চিত করাই সুশাসনের পরিচায়ক।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে নিজ নিজ দলের কৃতিত্ব দাবি করছেন নেতারা। ছাত্র-জনতার সঙ্গে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি এমনকি জাতীয় পার্টিও বিবৃতি দিয়ে নিজেদের ত্যাগের কথা বলছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদ এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ভোট দিতে পারেননি বাংলাদেশের জনগণ। দলগুলোও মুখিয়ে আছে নির্বাচনের জন্য। কাজেই সংস্কারের নামে বেশি দেরি হলে কালক্ষেপণ মনে করবে তারা। এ ইস্যুতে আবার সবাই একজোট হয়ে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে, আন্তর্জাতিক ব্যক্ত্যিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সহজাত নেতৃত্বে দেশ ও জনগণকে একটি নিরাপদ পরিবেশ উপহার দিতে পারবে বলে বিশ্বাস করে সাধারণ মানুষ।