হাসান আজাদ
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:০৬ এএম
আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

তৌফিক-ই-ইলাহীর প্রভাবে বড় দাও সামিটের

মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল
তৌফিক-ই-ইলাহীর প্রভাবে বড় দাও সামিটের

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বৈঠকেই বাজিমাত করেছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আলোচিত কোম্পানি সামিট। কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই ওই বৈঠকে প্রতিষ্ঠানটিকে ১৭ হাজার কোটি টাকার এলএনজি টার্মিনালের কাজ দেওয়া হয়। মাত্র ১০ দিনের প্রক্রিয়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর একক সিদ্ধান্ত ও চাপে সামিটকে এই কাজ দেওয়া হয়। এজন্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের বিশেষ আইন কাজে লাগানো হয়। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী কোম্পানি সামিট। বিদ্যুৎ খাতের লুটপাটের অন্যতম অংশীদার। এই সময়ে সিঙ্গাপুরের শ্রেষ্ঠ ধনীদের তালিকায় নাম উঠিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আজিজ খান। বিদ্যুতের পাশাপাশি আমদানি করা গ্যাস সরবরাহের জন্য একটি এফএসআরইউর (ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল) মালিকানা রয়েছে এই কোম্পানির হাতে। এটিও বিশেষ আইনে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে টার্মিনালটি বন্ধ থাকার কারণে গ্যাস সরবরাহ করা নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বিশেষ আইনে করা সব চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। আমরা এখন ভাসমান টার্মিনালের চেয়ে স্থলভাগে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের চিন্তা করছি। এখন থেকে সব হবে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায়।’

জ্বালানি বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজারের মহেশখালীতে তৃতীয় এফএসআরইউ স্থাপনের জন্য বেশকিছু কোম্পানি আগ্রহ দেখায়। কিন্তু তৎকালীন জ্বালানি উপদেষ্টার নির্দেশে কেবল সামিটের প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করেই সামিটের প্রস্তাব আমলে নিয়ে তাদের কাজ দেওয়া হয়। এমনকি সামিটকে কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর কারিগরি কমিটি প্রতিবেদন দেয়। নিয়ম অনুযায়ী কারিগরি কমিটির প্রতিবেদনের পর প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ ও কাজের অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।

কালবেলার হাতে আসা নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ৩০ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সভাকক্ষে (দ্বিতীয় তলা) ‘গ্যাস পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভা’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। ওই সভার কার্যপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই বৈঠকেই মহেশখালীতে ভাসমান তৃতীয় এলএনজি টার্মিনালের কাজ সামিটে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে (১০ জুন) কারিগরি কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই বৈঠকে তৎকালীন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব (বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব) মো. মাহবুব হোসেন, তৎকালীন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান (বর্তমান পানিসম্পদ সচিব) নাজমুল আহসানসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

পরে ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কক্সবাজারের মহেশখালীতে দেশের তৃতীয় ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বা এফএসআরইউ নির্মাণের খসড়া চুক্তি অনুমোদন করে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুমোদিত খসড়া চুক্তি অনুযায়ী, টার্মিনাল চালুর পর থেকে ১৫ বছর মেয়াদে দৈনিক ৩ লাখ ডলার (চুক্তিতে উল্লিখিত বিনিময় হার অনুযায়ী ৩ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকার সমপরিমাণ) রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ পাবে সামিট। চুক্তি অনুযায়ী এলএনজি টার্মিনাল থেকে তাদের আয় হবে ডলারে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতিটি এলএনজি টার্মিনাল বছরে গড়ে পাঁচ দিন রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য বন্ধ রাখা যায়। এর বাইরেও প্রতি পাঁচ বছরে একবার দেড় থেকে সর্বোচ্চ দুই মাসের জন্য আলাদা করে রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য বন্ধ রাখা হয়। সে অনুযায়ী, কোনো বিপত্তি না ঘটলে ১৫ বছরে টার্মিনালটি বন্ধ রাখতে হতে পারে সর্বোচ্চ ২৪০ দিন (আট মাসের সমান)। সেক্ষেত্রে ১৫ বছরে টার্মিনালটি চালু থাকবে অন্তত ৫ হাজার ২৩৫ দিন। দৈনিক ৩ লাখ ডলার হিসাবে (কর ও মূসক বাদে) এ সময় রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ বাবদ সামিটের আয় হবে অন্তত ১৫৭ কোটি ৫ লাখ ডলার। চুক্তি অনুমোদনের সময়ে এতে উল্লিখিত বিনিময় হার অনুযায়ী (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সা) ১৫ বছরে টার্মিনালটি থেকে রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ বাবদ সামিটের আয় দাঁড়াবে অন্তত ১৭ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকায়। সামিটকে যেহেতু এই টাকা ডলারে পরিশোধ করা হবে, সেজন্য মুদ্রা বিনিময় হার বাড়লে ব্যয়ও বাড়বে।

এর আগে একই বছরের ১৪ জুন টার্মিনালটি নির্মাণসংক্রান্ত প্রস্তাব অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদনের পর সামিটের অনুকূলে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) ইস্যু করা হয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, সামিটকে যেভাবে কাজ দেওয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অবৈধ। তৎকালীন সরকারের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল বিষয়টি যাচাই-বাছাই করার। কিন্তু করেনি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাদ দেওয়া যেতে পারে। তার আগে প্রয়োজনীয়তা এবং অন্যান্য সবদিক বিবেচনা করতে হবে।

বর্তমানে দেশে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। দুটি টার্মিনালই কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবস্থিত। এর মধ্যে একটির মালিকানায় রয়েছে এক্সিলারেট এনার্জি। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ভাসমান এলএনজি টার্মিনালটি নির্মাণের জন্য পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি করে এক্সিলারেট। নির্মাণ শেষে ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট গ্যাস সরবরাহ শুরু করে কোম্পানিটি। ১৫ বছর মেয়াদি টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস সরবরাহের চুক্তি রয়েছে ২০৩২ সাল পর্যন্ত। আরেকটি টার্মিনালের মালিকানায় রয়েছে সামিট। টার্মিনালটি নির্মাণে পেট্রোবাংলার সঙ্গে সামিটের চুক্তি হয় ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল। এরপর ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল গ্যাস সরবরাহ শুরু করে কোম্পানিটি। এ টার্মিনালের মেয়াদ রয়েছে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত।

বর্তমানে সামিটের এই টার্মিনালটি বন্ধ রয়েছে। তিন মাস ধরে বন্ধ থাকা টার্মিনালটি চালু করতে একাধিকবার দিনক্ষণ নির্ধারণ করেও চালু করতে পারেনি সামিট। টার্মিনাল চালু করতে না পারলেও বন্ধ সময়ের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ২৭০ কোটি টাকা পেট্রোবাংলার কাছে দাবি করেছে সামিট। এই টার্মিনালটি নির্মাণেও বিশেষ ক্ষমতা আইনে টেন্ডার ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই কার্যাদেশ দেওয়া হয় সামিট গ্রুপকে। ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল চালু প্রথম টার্মিনালটি ৩ মাস ধরে অচলাবস্থায় কক্সবাজারের কাছাকাছি গভীর সাগরে পড়ে আছে। এদিকে এফএসআরইউ অচল হয়ে পড়ে থাকলেও, তা মেরামতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই সামিটের। ফলে দেশে গ্যাস সংকট দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে।

গত সপ্তাহে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি (আরপিজিসিএল) থেকে সামিটকে দেওয়া এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিকল টার্মিনাল সচল করার বিষয়ে সামিট গ্রুপ অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। টার্মিনাল দীর্ঘ সময় বিকল থাকায় দেশের ক্ষতি হচ্ছে। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, সামিটের মেরামতের কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা হতাশাজনক। এলএনজি টার্মিনাল বিকল হওয়ায় বিদ্যুৎ, সার এবং শিল্প খাতে চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, তিন মাস ধরে এফএসআরইউটি এভাবে অচল থাকার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ এই সামিট দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত কুক্ষিগত করে রেখেছে। বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প তাদের দেওয়া হয়েছে। ফলে বর্তমানে সরকার সামিটের কাছে এক প্রকার জিম্মি হয়ে আছে। সামিটের সব প্রকল্প জরুরি ভিত্তিতে পর্যালোচনা করলেও অনেক অনিয়ম ধরা পড়বে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আরও ৬৪ মৃত্যু / গাজায় এখনই খাদ্য প্রয়োজন: ডব্লিউএফপি

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৯ এপ্রিল : টিভিতে আজকের খেলা

১৯ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

ভাঙ্গুড়ায় নিখোঁজের একদিন পর স্কুলছাত্রের মরদেহ উদ্ধার

ভাঙ্গায় দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ, আহত অন্তত ২০ 

মালদ্বীপে বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ উদযাপন

বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় ড. ইউনুস, যা বললেন মুশফিকুল আনসারী

বিএনপি অফিস ভাঙচুরের মামলায় আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

স্বাস্থ্য পরামর্শ / চুলের চিকিৎসায় পিআরপি: সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা

১০

মগবাজার রেললাইনে বাস, অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন অর্ধশতাধিক যাত্রী

১১

সৌরজগত নিয়ে বিজ্ঞানবক্তা আসিফের বক্তৃতা শনিবার

১২

শাহবাগে আটক ছাত্রলীগ নেতা সুমিত সাহা

১৩

গভীর রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতার পদত্যাগ

১৪

থানায় বসে ওসির টাকা নেওয়ার ভিডিও ভাইরাল

১৫

সকালের মধ্যে ১৮ জেলায় ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

১৬

বিএনপি নেতাকে হাতুড়িপেটার ঘটনায় জামায়াত নেতা আটক

১৭

কুমিল্লায় জামায়াতের সম্মেলনে আ.লীগ নেতা

১৮

ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান মানেই আমেরিকার চোখে হুমকি

১৯

ইরানে ইসরায়েলের হামলার বিপজ্জনক তথ্য ফাঁস

২০
X